- Joined
- May 29, 2025
- Messages
- 135
- Reaction score
- 0
ইতিপূর্বে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে তা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রযোজ্য। অস্বাভাবিক অবস্থায় পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।
১. ভুল শুধরাতে গিয়ে ঘটিতব্য বড় ভুল থেকে সাবধান হওয়া :
এ কথা সবার জানা যে, দু’টি ক্ষতির মধ্যে বৃহত্তর ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ন্যূনতম ক্ষতি মেনে নেওয়া শরী‘আতের অন্যতম মূলনীতি। এ কারণেই মুনাফিকরা কাফির প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও নবী করীম (ছাঃ) তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন এবং তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করেছেন। কিন্তু তাদের তিনি হত্যা করতে যাননি এ কারণে যে, পাছে লোকে বলবে, মুহাম্মাদ নিজ অনুসারীদের হত্যা করেন। বিশেষতঃ মুনাফিকদের ব্যাপারটা মানুষের নিকট গোপন থাকার কারণে।
একইভাবে কুরায়শদের নির্মিত কা‘বা ঘর ভেঙ্গে দিয়ে তিনি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ভিত্তির উপর পুনঃনির্মাণ করতে যাননি। কেননা কুরায়শরা ছিল সদ্য মুসলমান; কিছুদিন আগেও জাহিলী যুগের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। নবী করীম (ছাঃ)-এর আশঙ্কা ছিল এখন কা‘বা ঘর ভেঙ্গে ফেললে কুরায়শরা তা ভাল মনে নেবে না। ফলে হাতিমের ভাঙ্গা অংশটুকু কা‘বার বাইরেই থেকে যায় এবং দরজাও মানুষের নাগালের বাইরে উঁচুতে থেকে যায়। যদিও এটা এক প্রকার যুলুম ও পাপ। তবুও কুরায়শদের ঈমান হারানোর তুলনায় তা ক্ষুদ্র।
তারও আগে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের উপাস্যদের- দেবীদের গালি দিতে নিষেধ করেছেন। যদিও এসব গালি-গালাজের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও নৈকট্য লাভের সম্ভাবনা আছে। তবুও তা নিষেধ করা হয়েছে। যাতে তারা আল্লাহকে গালি দেওয়ার সুযোগ না পায়। যা কিনা তুলনামূলক বিচারে আরও অনেক বড় পাপ।
এজন্যই কখনো কখনো দ্বীন প্রচারক অবৈধ বিষয় নিষেধ না করে চুপ করে থাকে। অথবা দেরিতে নিষেধ করে অথবা পদ্ধতি পাল্টে ফেলে, যাতে করে ভুল বিদূরিত হয় কিংবা বড় কোন অন্যায় সংঘটিত না হয়। প্রচারকের নিয়ত ভাল থাকলে এবং আল্লাহর পথে নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করলে একে ত্রুটি ও দুর্বলতা বলা চলে না। দ্বীনের সুবিধা বিবেচনা করেই সে এমন করেছে- অলসতা ও কাপুরুষতার বশে নয়।
লক্ষ্যণীয় যে, ভুলে বাধা দেওয়া ও ভুল সংশোধনের অনেক কৌশল আছে। অনেকে সে সব কৌশল অবলম্বন না করে ভুল নিষেধ করতে যায়। ফলে ভুল সংশোধন না হয়ে বরং উল্টো বড় ভুলে পতিত হয়।
২. যে ধরনের স্বভাব-চরিত্র থেকে ভুল হয় তা অনুধাবন করা:
কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে যা স্বভাবজাত বা সহজাত। যতই চেষ্টা করা হোক তা পুরোপুরি দূর করা যায় না। তবে তার পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং লাঘব করা সম্ভব। চূড়ান্তভাবে সোজা করতে গেলে তা দুঃখ-বেদনায় পর্যবসিত হবে। যেমন মহিলাদের বেলায় একথা প্রযোজ্য। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ لَنْ تَسْتَقِيْمَ لَكَ عَلَى طَرِيقَةٍ فَإِنِ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَبِهَا عِوَجٌ وَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهَا كَسَرْتَهَا وَكَسْرُهَا طَلاَقُهَا- ‘মহিলাকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনভাবেই তা তোমার জন্য সোজা হবে না। সুতরাং তুমি তার থেকে উপকৃত হ’তে চাইলে তাকে বাঁকা রেখেই উপকৃত হবে। আর যদি তুমি তাকে সোজা করতে যাও, তাহ’লে তাকে ভেঙ্গে ফেলবে। ওর ভাঙ্গন হ’ল তালাক’।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا- ‘তোমরা স্ত্রীলোকদের সদুপদেশ দিতে থাক। কেননা তারা পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট। পাঁজরের সবচেয়ে উপরের হাড়টা সবচেয়ে বেশী বাঁকা। সুতরাং তুমি যদি তা একদম সোজা করতে যাও, তাহ’লে তুমি তাকে ভেঙ্গে ফেলবে, আর যদি এমনিই ফেলে রাখ তাহ’লে তা সর্বদাই বাঁকা থেকে যাবে। অতএব তোমরা স্ত্রীলোকদের সদুপদেশ দিতে থাক’।[2]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, মহানবী (ছাঃ)-এর উক্তি (بِالنِّسَاءِ خَيْرًا) ‘মহিলাদের ভালভাবে উপদেশ দান অর্থ নম্রতার সাথে ধীরে-সুস্থে সোজা করা। বেশী জোরাজুরি করা যাবে না, তাহ’লে ভেঙ্গে যাবে। আবার উপদেশ না দিয়ে ফেলেও রাখা যাবে না, তাহ’লে সে সর্বদা বাঁকাই থেকে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে- কেবল মুবাহ বা বৈধ ক্ষেত্রেই সদুপদেশ দেওয়া বা না দেওয়া বিধেয়। মহিলারা যদি সরাসরি পাপে জড়িয়ে পড়ে কিংবা ফরয পরিত্যাগ করে তখন তাকে বাধা দেওয়া ফরয হয়ে দাঁড়াবে। হাদীছটিতে মানুষের মন জয় করা এবং আত্মার সঙ্গে ভালবাসা জন্মানোর কথা বলা হয়েছে। মহিলাদের বাঁকা স্বভাব হেতু তাদের সঙ্গে ক্ষমা ও সহিষ্ণু আচরণ করতে বলা হয়েছে। কেউ তাদের সোজা করতে চাইলে তাদের থেকে উপকার লাভের সুযোগই হয়তো হারিয়ে বসবে। অথচ কোন পুরুষের পক্ষে মহিলার সংস্রব ব্যতীত জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং জীবন-জীবিকায় সহযোগিতা লাভের ভিন্ন কোন উপায় নেই। যেন নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, নারীর প্রতি ধৈর্য ধারণ ব্যতীত তার থেকে জৈবিক চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়।[3]
৩. শারঈ বিষয়ে ভুল করা এবং ব্যক্তিগত বিষয়ে ভুল করার মাঝে পার্থক্য নিরূপণ :
আমাদের নিকট দ্বীন ইসলাম আমাদের ব্যক্তি সত্তা থেকেও মহা মূল্যবান। তাই আমাদের ব্যক্তিস্বার্থে আমরা যতটা ক্ষোভ ও রাগ দেখাব এবং সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করব, তার থেকেও অনেক বেশী রাগ ও ক্ষোভ এবং সাহায্য-সহযোগিতা আমরা দ্বীনের স্বার্থে করব। এজন্যই তুমি দেখবে- যার দ্বীনী জোশ দুর্বল তাকে কেউ গালি দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে ক্ষুব্ধ হয় এবং রাগ প্রকাশ করে। কিন্তু তারই পাশে একজন দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করলে সে মোটেও ক্ষুব্ধ হয় না। কিংবা একটু ক্ষুব্ধ হ’লেও তা হয় সংকোচ ও দুর্বলতা মিশ্রিত।
নবী করীম (ছাঃ) নিজের ক্ষেত্রে অশোভন আচরণকারীদের বেশী মাত্রায় ক্ষমা করতেন, বিশেষ করে অসভ্য বেদুঈনদের মনোরঞ্জনার্থে এমনটা তিনি হরহামেশাই করতেন। ছহীহ বুখারীতে আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
কিন্তু দ্বীনের ক্ষেত্রে অপরাধ করলে তিনি আল্লাহর খাতিরে রাগ করতেন। সামনে তার উদাহরণ আসবে।
এখানে আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা ভুল-ভ্রান্তি মুকাবিলায় লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
(১) বড় গোনাহ ও ছোট গোনাহের মধ্যে পার্থক্য করা : খোদ শরী‘আতে ছোট-বড় গোনাহের ভাগ করা হয়েছে। ছোট গোনাহে বাধা দানে যতটা তৎপর হ’তে হবে, বড় গোনাহে বাধা দানে তার থেকেও অনেক বেশী তৎপর থাকতে হবে।
(২) যিনি ভাল কাজে অগ্রণী, যার পাপ নেই বললেই চলে, যিনি নেকীর সাগরে সন্তরণশীল তার এবং যে আগাগোড়া পাপী, নিজের জীবনের উপর অত্যাচারকারী তার মাঝে পার্থক্য আমলে নিয়ে আদেশ-নিষেধ করতে হবে। কেননা ভাল কাজে সৎ পথে যে অগ্রণী তার থেকে যেমন আচরণ আশা করা যায়, অন্যদের থেকে তা করা যায় না। হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর নিম্নের ঘটনা থেকে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি।
আবুবকর (রাঃ)-এর মেয়ে আসমা বলেন, আমরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যাত্রা করেছিলাম। ‘আরজ’ নামক স্থানে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিশ্রামের জন্য নেমে পড়েন, আমরাও নেমে পড়ি। আয়েশা (রাঃ) বসেছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে আর আমি বসেছিলাম আমার পিতার পাশে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর সফরের বাহন ছিল একটাই উট। আবু বকর (রাঃ)-এর এক গোলাম সেটা দেখাশোনা বা তত্ত্বাবধান করছিল। আবুবকর (রাঃ) গোলামের খোঁজ করে যখন পেলেন তখন তার সাথে উট ছিল না। তিনি বললেন, তোমার উট কোথায়? সে বলল, আজ রাতে আমি সেটা হারিয়ে ফেলেছি। আবুবকর (রাঃ) বললেন, একটাই মাত্র উট, তাও তুমি হারিয়ে ফেললে! আবুবকর (রাঃ)-এর রাগ চড়ে গেল। ফলে তিনি গোলামটিকে মারতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা দেখে মুচকি হেসে বললেন, তোমরা এই মুহরিম (হাজী)-কে দেখ, সে করছেটা কি? আবু রাযমা বলেন, এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘তোমরা এই মুহরিমকে দেখ, সে করছে কি?’ এবং ‘মুচকি হাসি’ ছাড়া আর কিছুই করেননি।[5]
(৩) যার থেকে বহুবার ভুল-ভ্রান্তি ও পাপ কাজ হয়েছে এবং যে প্রথমবার তা করেছে উভয়ের ক্ষেত্রে নিষেধ করতে কিছু তারতম্য করতে হবে। বারবার পাপে লিপ্ত ব্যক্তিকে তুলনামূলক বেশী এবং কঠোর ভাবে নিষেধ করতে হবে।
(৪) প্রকাশ্যে পাপাচারী ও গোপনে পাপাচারীর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
(৫) যার দ্বীন পালনে দুর্বলতা ও কমজোরি রয়েছে এবং যার মনে সাহস যোগানো প্রয়োজন তার উপর কঠোর হওয়া সমীচীন হবে না।
(৬) ভুলকারী ও অপরাধীর অবস্থান/পদ ও ক্ষমতা হিসাবে নিয়ে নিষেধ করতে হবে। তবে এসব কিছুই করতে হবে ন্যায় ও ইনছাফের পথ আগলে রেখে।
(৭) অল্পবয়স্ক ভুলকারীকে তার বয়সের সাথে মানিয়ে নিষেধ করতে হবে।
ইমাম বুখারী (রহঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,أَنَّ الْحَسَنَ بْنَ عَلِىٍّ أَخَذَ تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ، فَجَعَلَهَا فِىْ فِيْهِ، فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِالْفَارِسِيَّةِ كَخٍ كَخٍ، أَمَا تَعْرِفُ أَنَّا لاَ نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ- ‘একদিন আলী (রাঃ)-এর ছেলে হাসান (রাঃ) যাকাতের একটি খেজুর নিয়ে মুখে পুরে দেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফারসী ভাষায় বলে ওঠেন- খক! খক!! বাবু, তুমি কি জান না আমরা যাকাত খাই না’?[6]
ত্বাবারানী যয়নাব বিনতে আবু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,أَنَّهَا دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَغْتَسِلُ، قَالَتْ فَأَخَذَ حِفْنَةً مِّنْ مَاءٍ فَضَرَبَ بِهَا وَجْهِيْ، وَقَالَ: وَرَاءَكِ أَيْ لَكَاعِ ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গোসল করছিলেন, এমন সময় যয়নাব (রাঃ) তাঁর কাছে হাযির হন। তিনি বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক অঞ্জলী পানি নিয়ে আমার মুখে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, আরে বেওকুফ বাচ্চা, পেছনে সরে যাও’।[7]
এতে বুঝা গেল, ছোট মানুষের ছোটত্ব তার ভুল সংশোধনে কোন বাধা হ’তে পারে না। বরং সচেতন করার লক্ষ্যে তাদের সংশোধন ও শিক্ষা দান আবশ্যক। এরূপ শিক্ষা শিশুর মগজে ভালভাবে বসে যায়, ভবিষ্যতেও তা তার কাজে লাগে। প্রথম হাদীছে শিশুকে পরহেযগারী শিখানো হয়েছে এবং দ্বিতীয় হাদীছে তাকে অনুমতি গ্রহণের আদব যেমন শিখানো হয়েছে, তেমনি অন্যের গোপনাঙ্গ না দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনি আরেকটি ঘটনা ছোট শিশু ওমর বিন আবু সালামা (রাঃ)-কে কেন্দ্র করে ঘটেছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর থেকে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে শিশুটা খাবারের পাত্রে হাত ঘুরাতে গিয়ে ভুল করেছিল তার ক্ষেত্রে নবী করীম (ছাঃ)-এর নির্দেশনাগুলো খুবই ছোট, সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট ছিল। এগুলো মনে রাখাও যেমন সহজ, তেমনি বুঝতেও কোন সমস্যা নেই। এজন্যই ঐ শিশু ছাহাবীর উপর কথাগুলো তাঁর জীবনের তরে প্রভাব ফেলেছিল। সেজন্য তিনি বলেছিলেন, এরপর থেকে এটাই আমার খাবার গ্রহণের রীতি হয়ে দাঁড়ায়।
(৮) অনাত্মীয় মহিলাদের নিষেধকালে সতর্কতা : কোন পুরুষ লোক অনাত্মীয় অপরিচিত মহিলাদের নিষেধ করতে গেলে যাতে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সাবধান হ’তে হবে। কোন কিশোরী কিংবা যুবতীর ভুল ধরতে গিয়ে যুবক বিশেষের কথা যেন নরম মিনমিনে ভাবের না হয়। এতে অনেক বিপদ জেঁকে বসে। এক্ষেত্রে বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বর্ষীয়ান লোকেরা ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। যিনি তাদের আদেশ-নিষেধ করবেন তাকে বরং ভাবতে হবে যে, এক্ষেত্রে তার কথা বলায় উপকার হবে কি-না। যদি তার জোর ধারণা জন্মে যে কথা বলায় উপকার হবে, তাহ’লে কথা বলবে, নচেৎ অল্পবয়সী স্বল্প বুদ্ধির কিশোরীদের সাথে কথা না বলে নীরব থাকবে। অনেক সময় তারা অপবাদ দিয়ে বসে এবং বাতিলের উপর অনড় থাকতে চায়।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আদেশ-নিষেধের কাজে নিয়োজিত মানুষের আদেশ-নিষেধ, প্রচার-প্রপাগান্ডা ও দলীল-প্রমাণ প্রদান সার্থক ও কার্যকরী করতে তার সামাজিক অবস্থানের একটা মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে সমাজের অবস্থা যা তাই থেকে যাবে। নিম্নে এতদসংশ্লিষ্ট ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক জনৈকা মহিলাকে নিষেধের একটি ঘটনা তুলে ধরা হ’ল।
আবু রুহমের দাস ওবায়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ لَقِىَ امْرَأَةً مُتَطَيِّبَةً تُرِيْدُ الْمَسْجِدَ فَقَالَ يَا أَمَةَ الْجَبَّارِ أَيْنَ تُرِيدِينَ قَالَتِ الْمَسْجِدَ قَالَ وَلَهُ تَطَيَّبْتِ قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : أَيُّمَا امْرَأَةٍ تَطَيَّبَتْ ثُمَّ خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ لَمْ تُقْبَلْ لَهَا صَلاَةٌ حَتَّى تَغْتَسِلَ-
‘সুগন্ধি মেখে মসজিদ পানে গমনেচ্ছু জনৈকা মহিলার সাথে আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে বলেন, হে প্রবল প্রতিপত্তিশালীর (আল্লাহর) দাসী, যাচ্ছ কোথায়? সে বলল, মসজিদে। তিনি বললেন, সেজন্যই কি খোশবু মেখেছ? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে মহিলাই সুগন্ধি মেখে মসজিদের দিকে বের হবে তার কোন ছালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে গোসল করে ফেলে’।[9]
ছহীহ ইবনু খুযায়মা গ্রন্থে আছে,
مَرَّتْ بِأَبِيْ هُرَيْرَةَ امْرَأَةٌ وَرِيْحُهَا تَعْصِفُ، فَقَالَ لَهَا : إِلَى أَيْنَ تُرِيْدِيْنَ يَا أَمَةَ الْجَبَّارِ؟ قَالَتْ : إِلَى الْمَسْجِدِ، قَالَ : تَطَيَّبْتِ؟ قَالَتْ : نَعَمْ، قَالَ : فَارْجِعِيْ فَاغْتَسِلِيْ، فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : لاَ يُقْبَلُ اللهُ مِنْ امْرَأَةٍ صَلاَةً خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ وَرِيْحُهَا تَعْصِفُ حَتَّى تَرْجِعَ فَتَغْتَسِلَ-
‘আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর পাশ দিয়ে এক মহিলা যাচ্ছিল। তার গা থেকে সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, হে প্রতাপশালীর দাসী, যাচ্ছ কোথায়? সে বলল, মসজিদে। তিনি বললেন, তাইতো সুগন্ধি মেখেছ। সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে বাড়ি ফিরে গিয়ে গোসল করে নাও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে মহিলা সুগন্ধি ছড়াতে ছড়াতে মসজিদে যায়- বাড়ি ফিরে এসে গোসল না করা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তার কোন ছালাতই কবুল করেন না’।[10]
(৯) ভুল ও তার কারণ দূরীকরণের চেষ্টা বাদ দিয়ে ভুলের ফলে সৃষ্ট প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সংশোধনে ব্রতী না হওয়া উচিত। (পচা ইঁদুর পানিতে রেখে পানির দুর্গন্ধ দূর করার চেষ্টা ফলদায়ক হয় না)।
(১০) কোন ভুল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে হবে না এবং ভুলের প্রকৃতি চিত্রায়নে অতিরঞ্জন পরিহার করতে হবে।
(১১) ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগার মানসিকতা বাদ দিতে হবে। না বুঝে না জেনে কারো ভুল ধরা যাবে না। ভুলকারীর ভুলের পক্ষে স্বীকারোক্তি আদায়ে বেশী তৎপরতা দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
(১২) ভুল সংশোধনের জন্য ভুলে পতিতদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘকাল ধরে ভুলের মধ্যে লিপ্ত এবং ভুলে অভ্যস্ত তাদের বেলায় তাড়াহুড়া করলে তা হিতে বিপরীত হ’তে পারে। অবশ্য এ সময়ের মধ্যেও ভুল সংশোধনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকা চলবে না।
(১৩) ভুলে পতিত ব্যক্তি যেন কস্মিনকালেও মনে না করে যে সংশোধনকামী তার প্রতিপক্ষ। মনে রাখতে হবে- কিছু মানুষকে হাত করা কিছু অবস্থান হাছিল করা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লিখিত ভূমিকার পর এখন আমরা মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত পথ ও পদ্ধতি তুলে ধরব- যেমনটা ছহীহ হাদীছে এসেছে এবং বিদগ্ধজনেরা উল্লেখ করেছেন।
মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত পদ্ধতি :
১. ভুল সংশোধনে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং শিথিলতা না করা :
ভুল সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ) দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন। তাঁর জন্য দেরি করে বর্ণনা করা মোটেও বৈধ ছিল না। জনগণের সামনে সত্য ও ন্যায়কে তুলে ধরা এবং কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ তা নির্দেশ করা তাঁর আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে ছিল। মানুষের ভুল সংশোধনে তিনি যে বহু উপলক্ষে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অনেক ঘটনাই তার সাক্ষী হয়ে আছে। যেমন ছালাতে ভুলকারীর ঘটনা, মাখযূমী বংশের (চার মহিলার ঘটনা), যাকাত আদায়ে ইবনুল লুতবিয়ার ঘটনা। উসামা (রাঃ) কর্তৃক ভুলক্রমে একজন কালেমা পাঠকারীকে হত্যার ঘটনা, যে তিন ব্যক্তি নিজেদের উপর কড়াকড়ি আরোপ ও ঘর-সংসার ত্যাগের সংকল্প করেছিল তাদের ঘটনা ইত্যাদি। দ্রুত সংশোধনের ব্যবস্থা না নিলে ভুল সংশোধনের সুযোগ অনেক সময় হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিক সংশোধনে যে উপকারিতা পাওয়ার কথা তা আর মেলে না। অনেক সময় সংশোধনের সুযোগ চলে যায়, উপলক্ষ নস্যাৎ হয়ে যায়, ঘটনা ঠান্ডা মেরে যায় এবং বিলম্ব হেতু তার প্রতিক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে।
২. বিধান বর্ণনার মাধ্যমে ভুলের প্রতিকার :
জারহাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, أَنَّ النَّبِىَّ مََرَّ بِهِ وَهُوَ كَاشِفٌ عَنْ فَخِذِهِ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم غَطِّ فَخِذَكَ فَإِنَّهَا مِنَ الْعَوْرَةِ- ‘নবী করীম (ছাঃ) তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর উরু খোলা ছিল। তা দেখে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমার উরু ঢেকে রাখ। কেননা উরু সতরের অন্তর্ভুক্ত’।[11]
৩. ভুলকারীদের শরী‘আতের দিকে ফিরিয়ে আনা এবং যে মূলনীতির তারা খেলাফ করেছে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া :
পাপ-পংকিলতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে এবং উদ্ভূত অবস্থায় জড়িয়ে গেলে মানুষের মন-মগয থেকে শরী‘আতের অনেক বিধি-বিধান গায়েব হয়ে যায়। অনেক সময় সংঘাতে জড়িয়ে তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। এমন পুনঃপুনঃ মূলনীতির ঘোষণা দিলে এবং শরী‘আতের বিধি উচ্চৈঃস্বরে বললে যারা ভুল করেছে তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে এবং যে উদাসীনতা দেখা দিয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। মুনাফিকরা আনছার ও মুহাজিরদের মধ্যে ফিৎনার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ায় তাদের মাঝে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে চলেছিল তা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা উল্লিখিত বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত দৃষ্টান্ত বুঝতে পারব।
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর ছহীহ গ্রন্থে জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
غَزَوْنَا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ ثَابَ مَعَهُ نَاسٌ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ حَتَّى كَثُرُوْا، وَكَانَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ رَجُلٌ لَعَّابٌ فَكَسَعَ أَنْصَارِيًّا، فَغَضِبَ الأَنْصَارِىُّ غَضَبًا شَدِيدًا، حَتَّى تَدَاعَوْا، وَقَالَ الأَنْصَارِىُّ يَا لَلأَنْصَارِ. وَقَالَ الْمُهَاجِرِىُّ يَا لَلْمُهَاجِرِينَ. فَخَرَجَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : مَا بَالُ دَعْوَى أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ. ثُمَّ قَالَ : مَا شَأْنُهُمْ. فَأُخْبِرَ بِكَسْعَةِ الْمُهَاجِرِىِّ الأَنْصَارِىَّ قَالَ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم دَعُوهَا فَإِنَّهَا خَبِيْثَةٌ-
‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। মুহাজিরদের মধ্যে বহু সংখ্যক লোক তাঁর পাশে জমা হয়েছিল। ফলে তারা সংখ্যায় বেশী হয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে মুহাজিরদের মাঝে একজন বড়ই কৌতুকবায ছিল। সে একজন আনছারীর পশ্চাৎদেশে কৌতুক করে আঘাত করে। এতে ঐ আনছারী ভীষণ রেগে যায়। তখন দু’পক্ষই নিজেদের লোকদের ডাকাডাকি আরম্ভ করে। আনছারী বলে, ওহে আনছারগণ! আমার সাহায্যে এগিয়ে এসো। মুহাজির বলে, ওহে মুহাজিরগণ! আমার সাহায্যে এগিয়ে এসো। এমতাবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) বেরিয়ে এসে বললেন, জাহিলিয়াতপন্থীদের ডাকাডাকির মত ডাকাডাকি কেন? তারপর তিনি তাদের মধ্যে কী ঘটেছে তা জানতে চাইলেন। তাঁকে মুহাজির কর্তৃক আনছারীর পশ্চাৎদেশে আঘাত করার কথা জানানো হ’ল। তিনি বললেন, এ কাজ (তামাশা করে কাউকে কিছু বলা কিংবা আঘাত করা এবং গোত্রের সাহায্য নিয়ে অবৈধ সংঘাতের জন্য আহবান) ত্যাগ কর। কেননা এটা খুবই কদর্য’।[12]
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, وَلْيَنْصُرِ الرَّجُلُ أَخَاهُ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا إِنْ كَانَ ظَالِمًا فَلْيَنْهَهُ فَإِنَّهُ لَهُ نَصْرٌ وَإِنْ كَانَ مَظْلُوْمًا فَلْيَنْصُرْهُ ‘মানুষ যেন তার ভাইকে সাহায্য করে চাই সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত হোক। যদি সে অত্যাচারী হয় তাহ’লে তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখবে। এটাই হবে তার জন্য সাহায্য। আর যদি অত্যাচারিত হয়, তাহ’লে অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে তাকে সাহায্য করবে’।[13]
৪. ধারণায় ত্রুটির কারণে যে ভুল ধরা পড়ে সেখানে ধারণার সংশোধন :
ছহীহ বুখারীতে হুমাইদ বিন আবু হুমাইদ আত-তাবীল থেকে বর্ণিত, তিনি আনাস বিন মালিক (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন,
جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوْتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُوْنَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوْهَا فَقَالُوْا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ. قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّى أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدً. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُوْمُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا. فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّىْ لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّىْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ-
‘তিন জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ী গিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জানতে চান! তাদেরকে তা জানানো হ’লে মনে হ’ল যেন তারা তা অল্প গণ্য করল। তারা বলাবলি করল, কোথায় নবী করীম (ছাঃ) আর কোথায় আমরা? তাঁর তো আগে-পরের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের একজন বলল, আমি রাতে সারাক্ষণ ছালাতে রত থাকব। আরেকজন বলল, আমি সারা বছর ছিয়াম পালন করব, কখনই তা ভঙ্গ করব না। অন্যজন বলল, আমি নারী সংশ্রব ত্যাগ করব; কোনদিন বিয়ে করব না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কাছে এসে বললেন, তোমরাই তো তারা, যারা এমন এমন কথা বলেছ? শোন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাদের তুলনায় আল্লাহ তা‘আলাকে বেশী ভয় করি। কিন্তু আমি ছিয়াম পালন করি, আবার বিরতিও দেই; ছালাত আদায় করি, আবার ঘুমাই এবং বিয়ে-শাদীও করেছি’।[14]
মুসলিমের বর্ণনায় আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,
أَنَّ نَفَرًا مِنْ أَصْحَابِ النبِي صلى الله عليه وسلم سَأَلُوا أَزْوَاجَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم عَنْ عَمَلِهِ فِى السِّرِّ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ أَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ آكُلُ اللَّحْمَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ أَنَامُ عَلَى فِرَاشٍ. فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ. فَقَالَ : مَا بَالُ أَقْوَامٍ قَالُوا كَذَا وَكَذَا لَكِنِّى أُصَلِّى وَأَنَامُ وَأَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى-
‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কতিপয় ছাহাবী তাঁর স্ত্রীদের নিকট গিয়ে নির্জন মুহূর্তে তাঁর আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তা জানার পর তাদের একজন বলল, আমি বিয়ে-শাদী করব না। অন্যজন বলল, আমি গোশত খাব না। আরেকজন বলল, আমি বিছানায় ঘুমাব না। এসব কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর বললেন, ঐসব লোকের কী হ’ল যারা এমন এমন কথা বলে? আমি তো নফল ছালাত আদায় করি, ঘুমাই, ছাওম পালন করি আবার বাদ দেই। নারীদের বিয়ে-শাদীও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাতের প্রতি অনাসক্তি দেখাবে সে আমার দলভুক্ত থাকবে না’।[15]
আমরা এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে পারি :
(১) নবী করীম (ছাঃ) তাদের ও তাঁর মাঝে সংঘটিত বিষয়ে খোদ তাদের কাছে এসে সরাসরি তাদের উপদেশ দিয়েছেন। তবে তিনি যখন সাধারণভাবে সকলকে উপদেশ দিতে চাইতেন, তখন লোকদের কী হয়েছে... এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার করতেন। নাম উল্লেখ করে কাউকে ছোট করতেন না। এতে ছাহাবীদের প্রতি তাঁর স্নেহশীলতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি তাদের নামও অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে। আবার সাধারণভাবে জানানোর উদ্দেশ্যও হাছিল হচ্ছে।
(২) হাদীছে বড়দের আমলের অবস্থা জানার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়- এতে উদ্দেশ্য তাঁদের আমলের মত আমল করা এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। আবার তাদের আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে সঠিক পথে পরিচালিত করা যেমন পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয়, তেমনি তাদের আত্মার পরিচর্যাও করা হয়।
(৩) উপকারী ও শরী‘আতসম্মত যে সকল বিষয় পুরুষদের থেকে জানা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়, সেগুলোর অনুসন্ধান নারীদের কাছে করা যায়।
(৪) ব্যক্তি বিশেষের নিজের আমলের কথা অন্যদের বলাতে কোন দোষ হবে না- যখন ব্যক্তি লোক দেখানো কাজ করছে না মর্মে নিশ্চিত হবে এবং তাতে অন্যদেরও উপকার হবে।
(৫) ইবাদতে অতিরঞ্জন মনের মধ্যে বিরক্তি ও ক্লান্তির জন্ম দেয়, ফলে মূল ইবাদতই এক সময় আর করা হয়ে ওঠে না। সব ক্ষেত্রেই আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত।[16]
(৬) সাধারণতঃ ধ্যান-ধারণার ত্রুটি থেকে ভুল-ভ্রান্তির জন্ম হয়। সুতরাং ধ্যান-ধারণা সঠিক হ’লে ভুলের মাত্রা অবশ্যই কমে যাবে। উক্ত হাদীছ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়- বর্ণিত ছাহাবীদের সংসার ত্যাগ, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ এবং কঠোর সাধনার ইচ্ছা জেগেছিল তাদের এই ভাবনা থেকে যে, আখিরাতে মুক্তি পেতে হ’লে তাদের নবী করীম (ছাঃ) থেকে অনেক বেশী ইবাদত করতে হবে। কেননা তাঁকে তো তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে; যা তাদের জানানো হয়নি। এমতাবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) তাদের ভুল ধারণা সংশোধন করে দেন। তিনি বুঝিয়ে দেন যে, তাদের ধারণা সঠিক পথ থেকে এক পেশে হয়ে গেছে। সঠিক ধারণা এই যে, যদিও আল্লাহ তাঁর নবীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও আল্লাহকে তিনিই সবচেয়ে বেশী ভয় করেন, তাক্বওয়াও তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী।
সুতরাং আল্লাহকে ভয় করতে এবং তার ক্ষমা পেতে চাইলে নবীর আদর্শ থেকে উন্নত আদর্শ আর কোনটাই হ’তে পারে না। সেজন্য তিনি সবাইকে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে এবং তাঁর পদ্ধতিতে ইবাদত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর কাছাকাছি আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল কাহমাস আল-হিলালী নামক একজন ছাহাবীর ক্ষেত্রে। তিনি নিজে বলেছেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে আমার মুসলিম হওয়ার কথা তাঁকে জানালাম। ইতিমধ্যে এক বছর কেটে গেল। এ সময় আমি কাহিল হয়ে পড়ি এবং আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বছর শেষে আমি তাঁর কাছে এলে তিনি একবার চোখ নিচু করে আমাকে দেখেন, আবার চোখ তুলে ধরেন। আমি বললাম, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? তিনি বললেন, তুমি কে? আমি বললাম, আমি কাহমাস আল-হিলালী। তিনি বললেন, তোমার এ বেহাল দশা কেন? আমি বললাম, আপনার নিকট থেকে যাওয়ার পর আমি একদিনও ছাওম পালন বাদ দেইনি এবং এক রাতও ঘুমাইনি। তিনি বললেন, তোমার দেহকে এমন শাস্তি দিতে কে আদেশ দিয়েছে? তুমি বরং ধৈর্যের (রামাযান) মাস এবং প্রত্যেক মাসে একদিন ছাওম রাখ। আমি বললাম, আমাকে বাড়িয়ে দিন। তিনি বললেন, ধৈর্যের মাস আর প্রত্যেক মাসে দু’দিন। আমি বললাম, আমাকে আরও বাড়িয়ে দিন, আমার সামর্থ্য আছে। তিনি বললেন, ধৈর্যের মাস এবং প্রত্যেক মাসে তিন দিন রাখ’।[17]
মানুষের মর্যাদা নির্ণয়েও অনেক সময় ধারণাগত ভ্রান্তি হয়। এরূপ ভুল সংশোধনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আগ্রহী ছিলেন। ছহীহ বুখারীতে সাহল ইবনু সা‘দ আস-সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
ইবনু মাজাহর বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে একজন লোক গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমরা কী বল? তারা বললেন, আমরা তো বলি, ইনি একজন অভিজাত লোক। ইনি এতটাই উপযুক্ত যে, বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাব গ্রহণ করা চলে, সুফারিশ করলে সে সুফারিশ মেনে নেয়া যায়, আর যদি কথা বলেন, তবে তা কান লাগিয়ে শোনা চলে। নবী করীম (ছাঃ) (কোন মন্তব্য না করে) চুপ করে থাকলেন। পরে আরেকজন লোক গেল। তার সম্বন্ধে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এর সম্পর্কে তোমরা কী বল? তারা বললেন, ইনি একজন দরিদ্র মুসলিম। ইনি এমন যে, বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না; কোন সুফারিশ করলে সে সুফারিশ রক্ষা করা চলে না এবং কোন কথা বললে তা শোনার যোগ্য হবে না। এবার নবী করীম (ছাঃ) মন্তব্য করলেন, অথচ এই (দরিদ্র মুসলিম) লোকটা ঐ (অভিজাত) লোকের মত দুনিয়া ভরা লোকের থেকেও শ্রেষ্ঠ’।[19]
[চলবে]
১. ভুল শুধরাতে গিয়ে ঘটিতব্য বড় ভুল থেকে সাবধান হওয়া :
এ কথা সবার জানা যে, দু’টি ক্ষতির মধ্যে বৃহত্তর ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ন্যূনতম ক্ষতি মেনে নেওয়া শরী‘আতের অন্যতম মূলনীতি। এ কারণেই মুনাফিকরা কাফির প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও নবী করীম (ছাঃ) তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন এবং তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ করেছেন। কিন্তু তাদের তিনি হত্যা করতে যাননি এ কারণে যে, পাছে লোকে বলবে, মুহাম্মাদ নিজ অনুসারীদের হত্যা করেন। বিশেষতঃ মুনাফিকদের ব্যাপারটা মানুষের নিকট গোপন থাকার কারণে।
একইভাবে কুরায়শদের নির্মিত কা‘বা ঘর ভেঙ্গে দিয়ে তিনি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ভিত্তির উপর পুনঃনির্মাণ করতে যাননি। কেননা কুরায়শরা ছিল সদ্য মুসলমান; কিছুদিন আগেও জাহিলী যুগের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। নবী করীম (ছাঃ)-এর আশঙ্কা ছিল এখন কা‘বা ঘর ভেঙ্গে ফেললে কুরায়শরা তা ভাল মনে নেবে না। ফলে হাতিমের ভাঙ্গা অংশটুকু কা‘বার বাইরেই থেকে যায় এবং দরজাও মানুষের নাগালের বাইরে উঁচুতে থেকে যায়। যদিও এটা এক প্রকার যুলুম ও পাপ। তবুও কুরায়শদের ঈমান হারানোর তুলনায় তা ক্ষুদ্র।
তারও আগে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের উপাস্যদের- দেবীদের গালি দিতে নিষেধ করেছেন। যদিও এসব গালি-গালাজের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও নৈকট্য লাভের সম্ভাবনা আছে। তবুও তা নিষেধ করা হয়েছে। যাতে তারা আল্লাহকে গালি দেওয়ার সুযোগ না পায়। যা কিনা তুলনামূলক বিচারে আরও অনেক বড় পাপ।
এজন্যই কখনো কখনো দ্বীন প্রচারক অবৈধ বিষয় নিষেধ না করে চুপ করে থাকে। অথবা দেরিতে নিষেধ করে অথবা পদ্ধতি পাল্টে ফেলে, যাতে করে ভুল বিদূরিত হয় কিংবা বড় কোন অন্যায় সংঘটিত না হয়। প্রচারকের নিয়ত ভাল থাকলে এবং আল্লাহর পথে নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করলে একে ত্রুটি ও দুর্বলতা বলা চলে না। দ্বীনের সুবিধা বিবেচনা করেই সে এমন করেছে- অলসতা ও কাপুরুষতার বশে নয়।
লক্ষ্যণীয় যে, ভুলে বাধা দেওয়া ও ভুল সংশোধনের অনেক কৌশল আছে। অনেকে সে সব কৌশল অবলম্বন না করে ভুল নিষেধ করতে যায়। ফলে ভুল সংশোধন না হয়ে বরং উল্টো বড় ভুলে পতিত হয়।
২. যে ধরনের স্বভাব-চরিত্র থেকে ভুল হয় তা অনুধাবন করা:
কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে যা স্বভাবজাত বা সহজাত। যতই চেষ্টা করা হোক তা পুরোপুরি দূর করা যায় না। তবে তার পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং লাঘব করা সম্ভব। চূড়ান্তভাবে সোজা করতে গেলে তা দুঃখ-বেদনায় পর্যবসিত হবে। যেমন মহিলাদের বেলায় একথা প্রযোজ্য। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ لَنْ تَسْتَقِيْمَ لَكَ عَلَى طَرِيقَةٍ فَإِنِ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَبِهَا عِوَجٌ وَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهَا كَسَرْتَهَا وَكَسْرُهَا طَلاَقُهَا- ‘মহিলাকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনভাবেই তা তোমার জন্য সোজা হবে না। সুতরাং তুমি তার থেকে উপকৃত হ’তে চাইলে তাকে বাঁকা রেখেই উপকৃত হবে। আর যদি তুমি তাকে সোজা করতে যাও, তাহ’লে তাকে ভেঙ্গে ফেলবে। ওর ভাঙ্গন হ’ল তালাক’।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّهُنَّ خُلِقْنَ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا- ‘তোমরা স্ত্রীলোকদের সদুপদেশ দিতে থাক। কেননা তারা পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট। পাঁজরের সবচেয়ে উপরের হাড়টা সবচেয়ে বেশী বাঁকা। সুতরাং তুমি যদি তা একদম সোজা করতে যাও, তাহ’লে তুমি তাকে ভেঙ্গে ফেলবে, আর যদি এমনিই ফেলে রাখ তাহ’লে তা সর্বদাই বাঁকা থেকে যাবে। অতএব তোমরা স্ত্রীলোকদের সদুপদেশ দিতে থাক’।[2]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, মহানবী (ছাঃ)-এর উক্তি (بِالنِّسَاءِ خَيْرًا) ‘মহিলাদের ভালভাবে উপদেশ দান অর্থ নম্রতার সাথে ধীরে-সুস্থে সোজা করা। বেশী জোরাজুরি করা যাবে না, তাহ’লে ভেঙ্গে যাবে। আবার উপদেশ না দিয়ে ফেলেও রাখা যাবে না, তাহ’লে সে সর্বদা বাঁকাই থেকে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে- কেবল মুবাহ বা বৈধ ক্ষেত্রেই সদুপদেশ দেওয়া বা না দেওয়া বিধেয়। মহিলারা যদি সরাসরি পাপে জড়িয়ে পড়ে কিংবা ফরয পরিত্যাগ করে তখন তাকে বাধা দেওয়া ফরয হয়ে দাঁড়াবে। হাদীছটিতে মানুষের মন জয় করা এবং আত্মার সঙ্গে ভালবাসা জন্মানোর কথা বলা হয়েছে। মহিলাদের বাঁকা স্বভাব হেতু তাদের সঙ্গে ক্ষমা ও সহিষ্ণু আচরণ করতে বলা হয়েছে। কেউ তাদের সোজা করতে চাইলে তাদের থেকে উপকার লাভের সুযোগই হয়তো হারিয়ে বসবে। অথচ কোন পুরুষের পক্ষে মহিলার সংস্রব ব্যতীত জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং জীবন-জীবিকায় সহযোগিতা লাভের ভিন্ন কোন উপায় নেই। যেন নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, নারীর প্রতি ধৈর্য ধারণ ব্যতীত তার থেকে জৈবিক চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়।[3]
৩. শারঈ বিষয়ে ভুল করা এবং ব্যক্তিগত বিষয়ে ভুল করার মাঝে পার্থক্য নিরূপণ :
আমাদের নিকট দ্বীন ইসলাম আমাদের ব্যক্তি সত্তা থেকেও মহা মূল্যবান। তাই আমাদের ব্যক্তিস্বার্থে আমরা যতটা ক্ষোভ ও রাগ দেখাব এবং সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করব, তার থেকেও অনেক বেশী রাগ ও ক্ষোভ এবং সাহায্য-সহযোগিতা আমরা দ্বীনের স্বার্থে করব। এজন্যই তুমি দেখবে- যার দ্বীনী জোশ দুর্বল তাকে কেউ গালি দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে ক্ষুব্ধ হয় এবং রাগ প্রকাশ করে। কিন্তু তারই পাশে একজন দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করলে সে মোটেও ক্ষুব্ধ হয় না। কিংবা একটু ক্ষুব্ধ হ’লেও তা হয় সংকোচ ও দুর্বলতা মিশ্রিত।
নবী করীম (ছাঃ) নিজের ক্ষেত্রে অশোভন আচরণকারীদের বেশী মাত্রায় ক্ষমা করতেন, বিশেষ করে অসভ্য বেদুঈনদের মনোরঞ্জনার্থে এমনটা তিনি হরহামেশাই করতেন। ছহীহ বুখারীতে আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
كُنْتُ أَمْشِى مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِىٌّ غَلِيظُ الْحَاشِيَةِ، فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِىٌّ فَجَبَذَهُ بِرِدَائِهِ جَبْذَةً شَدِيْدَةً، حَتَّى نَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ أَثَّرَتْ بِهَا حَاشِيَةُ الْبُرْدِ مِنْ شِدَّةِ جَبْذَتِهِ، ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ مُرْ لِى مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِى عِنْدَكَ. فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ ضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ-
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে পায়ে হেঁটে পথ চলছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল নাজরানের তৈরী মোটা পাড়ের একটি বড় চাদর। এমন সময় এক বেদুইন এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাদর ধরে খুব জোরে এক হ্যাঁচকা টান দিল। আমি দেখলাম কঠিনভাবে টানার কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাঁধের উপরিভাগে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর লোকটা বলল, হে মুহাম্মাদ! তোমার নিকট আল্লাহর যে সম্পদ রয়েছে তা থেকে আমাকে কিছু দিতে আদেশ দাও। এমন (অসভ্য আচরণ সত্ত্বেও) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হেসে দিলেন এবং তাকে অনুদান প্রদানের আদেশ দিলেন’।[4]কিন্তু দ্বীনের ক্ষেত্রে অপরাধ করলে তিনি আল্লাহর খাতিরে রাগ করতেন। সামনে তার উদাহরণ আসবে।
এখানে আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা ভুল-ভ্রান্তি মুকাবিলায় লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
(১) বড় গোনাহ ও ছোট গোনাহের মধ্যে পার্থক্য করা : খোদ শরী‘আতে ছোট-বড় গোনাহের ভাগ করা হয়েছে। ছোট গোনাহে বাধা দানে যতটা তৎপর হ’তে হবে, বড় গোনাহে বাধা দানে তার থেকেও অনেক বেশী তৎপর থাকতে হবে।
(২) যিনি ভাল কাজে অগ্রণী, যার পাপ নেই বললেই চলে, যিনি নেকীর সাগরে সন্তরণশীল তার এবং যে আগাগোড়া পাপী, নিজের জীবনের উপর অত্যাচারকারী তার মাঝে পার্থক্য আমলে নিয়ে আদেশ-নিষেধ করতে হবে। কেননা ভাল কাজে সৎ পথে যে অগ্রণী তার থেকে যেমন আচরণ আশা করা যায়, অন্যদের থেকে তা করা যায় না। হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর নিম্নের ঘটনা থেকে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি।
আবুবকর (রাঃ)-এর মেয়ে আসমা বলেন, আমরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে যাত্রা করেছিলাম। ‘আরজ’ নামক স্থানে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিশ্রামের জন্য নেমে পড়েন, আমরাও নেমে পড়ি। আয়েশা (রাঃ) বসেছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে আর আমি বসেছিলাম আমার পিতার পাশে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর সফরের বাহন ছিল একটাই উট। আবু বকর (রাঃ)-এর এক গোলাম সেটা দেখাশোনা বা তত্ত্বাবধান করছিল। আবুবকর (রাঃ) গোলামের খোঁজ করে যখন পেলেন তখন তার সাথে উট ছিল না। তিনি বললেন, তোমার উট কোথায়? সে বলল, আজ রাতে আমি সেটা হারিয়ে ফেলেছি। আবুবকর (রাঃ) বললেন, একটাই মাত্র উট, তাও তুমি হারিয়ে ফেললে! আবুবকর (রাঃ)-এর রাগ চড়ে গেল। ফলে তিনি গোলামটিকে মারতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা দেখে মুচকি হেসে বললেন, তোমরা এই মুহরিম (হাজী)-কে দেখ, সে করছেটা কি? আবু রাযমা বলেন, এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘তোমরা এই মুহরিমকে দেখ, সে করছে কি?’ এবং ‘মুচকি হাসি’ ছাড়া আর কিছুই করেননি।[5]
(৩) যার থেকে বহুবার ভুল-ভ্রান্তি ও পাপ কাজ হয়েছে এবং যে প্রথমবার তা করেছে উভয়ের ক্ষেত্রে নিষেধ করতে কিছু তারতম্য করতে হবে। বারবার পাপে লিপ্ত ব্যক্তিকে তুলনামূলক বেশী এবং কঠোর ভাবে নিষেধ করতে হবে।
(৪) প্রকাশ্যে পাপাচারী ও গোপনে পাপাচারীর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
(৫) যার দ্বীন পালনে দুর্বলতা ও কমজোরি রয়েছে এবং যার মনে সাহস যোগানো প্রয়োজন তার উপর কঠোর হওয়া সমীচীন হবে না।
(৬) ভুলকারী ও অপরাধীর অবস্থান/পদ ও ক্ষমতা হিসাবে নিয়ে নিষেধ করতে হবে। তবে এসব কিছুই করতে হবে ন্যায় ও ইনছাফের পথ আগলে রেখে।
(৭) অল্পবয়স্ক ভুলকারীকে তার বয়সের সাথে মানিয়ে নিষেধ করতে হবে।
ইমাম বুখারী (রহঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,أَنَّ الْحَسَنَ بْنَ عَلِىٍّ أَخَذَ تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ، فَجَعَلَهَا فِىْ فِيْهِ، فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِالْفَارِسِيَّةِ كَخٍ كَخٍ، أَمَا تَعْرِفُ أَنَّا لاَ نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ- ‘একদিন আলী (রাঃ)-এর ছেলে হাসান (রাঃ) যাকাতের একটি খেজুর নিয়ে মুখে পুরে দেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফারসী ভাষায় বলে ওঠেন- খক! খক!! বাবু, তুমি কি জান না আমরা যাকাত খাই না’?[6]
ত্বাবারানী যয়নাব বিনতে আবু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,أَنَّهَا دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَغْتَسِلُ، قَالَتْ فَأَخَذَ حِفْنَةً مِّنْ مَاءٍ فَضَرَبَ بِهَا وَجْهِيْ، وَقَالَ: وَرَاءَكِ أَيْ لَكَاعِ ‘একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গোসল করছিলেন, এমন সময় যয়নাব (রাঃ) তাঁর কাছে হাযির হন। তিনি বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক অঞ্জলী পানি নিয়ে আমার মুখে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, আরে বেওকুফ বাচ্চা, পেছনে সরে যাও’।[7]
এতে বুঝা গেল, ছোট মানুষের ছোটত্ব তার ভুল সংশোধনে কোন বাধা হ’তে পারে না। বরং সচেতন করার লক্ষ্যে তাদের সংশোধন ও শিক্ষা দান আবশ্যক। এরূপ শিক্ষা শিশুর মগজে ভালভাবে বসে যায়, ভবিষ্যতেও তা তার কাজে লাগে। প্রথম হাদীছে শিশুকে পরহেযগারী শিখানো হয়েছে এবং দ্বিতীয় হাদীছে তাকে অনুমতি গ্রহণের আদব যেমন শিখানো হয়েছে, তেমনি অন্যের গোপনাঙ্গ না দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনি আরেকটি ঘটনা ছোট শিশু ওমর বিন আবু সালামা (রাঃ)-কে কেন্দ্র করে ঘটেছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর থেকে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
كُنْتُ غُلاَمًا فِىْ حَجْرِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَتْ يَدِى تَطِيشُ فِى الصَّحْفَةِ فَقَالَ لِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا غُلاَمُ سَمِّ اللهَ، وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ. فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِى بَعْدُ-
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতিপালনাধীন একটা শিশু ছিলাম। একবার খাওয়ার সময় আমার হাত পাত্রের সবখানে খাবার খুঁজে ফিরছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, ওহে বৎস! খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম বল, ডান হাত দিয়ে খাও এবং তোমার পাশ থেকে খাও। এরপর থেকে এটাই আমার খাবার গ্রহণের রীতি হয়ে দাঁড়ায়’।[8]আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে শিশুটা খাবারের পাত্রে হাত ঘুরাতে গিয়ে ভুল করেছিল তার ক্ষেত্রে নবী করীম (ছাঃ)-এর নির্দেশনাগুলো খুবই ছোট, সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট ছিল। এগুলো মনে রাখাও যেমন সহজ, তেমনি বুঝতেও কোন সমস্যা নেই। এজন্যই ঐ শিশু ছাহাবীর উপর কথাগুলো তাঁর জীবনের তরে প্রভাব ফেলেছিল। সেজন্য তিনি বলেছিলেন, এরপর থেকে এটাই আমার খাবার গ্রহণের রীতি হয়ে দাঁড়ায়।
(৮) অনাত্মীয় মহিলাদের নিষেধকালে সতর্কতা : কোন পুরুষ লোক অনাত্মীয় অপরিচিত মহিলাদের নিষেধ করতে গেলে যাতে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সাবধান হ’তে হবে। কোন কিশোরী কিংবা যুবতীর ভুল ধরতে গিয়ে যুবক বিশেষের কথা যেন নরম মিনমিনে ভাবের না হয়। এতে অনেক বিপদ জেঁকে বসে। এক্ষেত্রে বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বর্ষীয়ান লোকেরা ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। যিনি তাদের আদেশ-নিষেধ করবেন তাকে বরং ভাবতে হবে যে, এক্ষেত্রে তার কথা বলায় উপকার হবে কি-না। যদি তার জোর ধারণা জন্মে যে কথা বলায় উপকার হবে, তাহ’লে কথা বলবে, নচেৎ অল্পবয়সী স্বল্প বুদ্ধির কিশোরীদের সাথে কথা না বলে নীরব থাকবে। অনেক সময় তারা অপবাদ দিয়ে বসে এবং বাতিলের উপর অনড় থাকতে চায়।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আদেশ-নিষেধের কাজে নিয়োজিত মানুষের আদেশ-নিষেধ, প্রচার-প্রপাগান্ডা ও দলীল-প্রমাণ প্রদান সার্থক ও কার্যকরী করতে তার সামাজিক অবস্থানের একটা মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। এই ভূমিকা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে সমাজের অবস্থা যা তাই থেকে যাবে। নিম্নে এতদসংশ্লিষ্ট ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক জনৈকা মহিলাকে নিষেধের একটি ঘটনা তুলে ধরা হ’ল।
আবু রুহমের দাস ওবায়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ لَقِىَ امْرَأَةً مُتَطَيِّبَةً تُرِيْدُ الْمَسْجِدَ فَقَالَ يَا أَمَةَ الْجَبَّارِ أَيْنَ تُرِيدِينَ قَالَتِ الْمَسْجِدَ قَالَ وَلَهُ تَطَيَّبْتِ قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : أَيُّمَا امْرَأَةٍ تَطَيَّبَتْ ثُمَّ خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ لَمْ تُقْبَلْ لَهَا صَلاَةٌ حَتَّى تَغْتَسِلَ-
‘সুগন্ধি মেখে মসজিদ পানে গমনেচ্ছু জনৈকা মহিলার সাথে আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে বলেন, হে প্রবল প্রতিপত্তিশালীর (আল্লাহর) দাসী, যাচ্ছ কোথায়? সে বলল, মসজিদে। তিনি বললেন, সেজন্যই কি খোশবু মেখেছ? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে মহিলাই সুগন্ধি মেখে মসজিদের দিকে বের হবে তার কোন ছালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে গোসল করে ফেলে’।[9]
ছহীহ ইবনু খুযায়মা গ্রন্থে আছে,
مَرَّتْ بِأَبِيْ هُرَيْرَةَ امْرَأَةٌ وَرِيْحُهَا تَعْصِفُ، فَقَالَ لَهَا : إِلَى أَيْنَ تُرِيْدِيْنَ يَا أَمَةَ الْجَبَّارِ؟ قَالَتْ : إِلَى الْمَسْجِدِ، قَالَ : تَطَيَّبْتِ؟ قَالَتْ : نَعَمْ، قَالَ : فَارْجِعِيْ فَاغْتَسِلِيْ، فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : لاَ يُقْبَلُ اللهُ مِنْ امْرَأَةٍ صَلاَةً خَرَجَتْ إِلَى الْمَسْجِدِ وَرِيْحُهَا تَعْصِفُ حَتَّى تَرْجِعَ فَتَغْتَسِلَ-
‘আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর পাশ দিয়ে এক মহিলা যাচ্ছিল। তার গা থেকে সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, হে প্রতাপশালীর দাসী, যাচ্ছ কোথায়? সে বলল, মসজিদে। তিনি বললেন, তাইতো সুগন্ধি মেখেছ। সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে বাড়ি ফিরে গিয়ে গোসল করে নাও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে মহিলা সুগন্ধি ছড়াতে ছড়াতে মসজিদে যায়- বাড়ি ফিরে এসে গোসল না করা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তার কোন ছালাতই কবুল করেন না’।[10]
(৯) ভুল ও তার কারণ দূরীকরণের চেষ্টা বাদ দিয়ে ভুলের ফলে সৃষ্ট প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সংশোধনে ব্রতী না হওয়া উচিত। (পচা ইঁদুর পানিতে রেখে পানির দুর্গন্ধ দূর করার চেষ্টা ফলদায়ক হয় না)।
(১০) কোন ভুল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে হবে না এবং ভুলের প্রকৃতি চিত্রায়নে অতিরঞ্জন পরিহার করতে হবে।
(১১) ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগার মানসিকতা বাদ দিতে হবে। না বুঝে না জেনে কারো ভুল ধরা যাবে না। ভুলকারীর ভুলের পক্ষে স্বীকারোক্তি আদায়ে বেশী তৎপরতা দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
(১২) ভুল সংশোধনের জন্য ভুলে পতিতদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘকাল ধরে ভুলের মধ্যে লিপ্ত এবং ভুলে অভ্যস্ত তাদের বেলায় তাড়াহুড়া করলে তা হিতে বিপরীত হ’তে পারে। অবশ্য এ সময়ের মধ্যেও ভুল সংশোধনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকা চলবে না।
(১৩) ভুলে পতিত ব্যক্তি যেন কস্মিনকালেও মনে না করে যে সংশোধনকামী তার প্রতিপক্ষ। মনে রাখতে হবে- কিছু মানুষকে হাত করা কিছু অবস্থান হাছিল করা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লিখিত ভূমিকার পর এখন আমরা মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত পথ ও পদ্ধতি তুলে ধরব- যেমনটা ছহীহ হাদীছে এসেছে এবং বিদগ্ধজনেরা উল্লেখ করেছেন।
মানুষের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত পদ্ধতি :
১. ভুল সংশোধনে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং শিথিলতা না করা :
ভুল সংশোধনে নবী করীম (ছাঃ) দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন। তাঁর জন্য দেরি করে বর্ণনা করা মোটেও বৈধ ছিল না। জনগণের সামনে সত্য ও ন্যায়কে তুলে ধরা এবং কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ তা নির্দেশ করা তাঁর আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে ছিল। মানুষের ভুল সংশোধনে তিনি যে বহু উপলক্ষে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অনেক ঘটনাই তার সাক্ষী হয়ে আছে। যেমন ছালাতে ভুলকারীর ঘটনা, মাখযূমী বংশের (চার মহিলার ঘটনা), যাকাত আদায়ে ইবনুল লুতবিয়ার ঘটনা। উসামা (রাঃ) কর্তৃক ভুলক্রমে একজন কালেমা পাঠকারীকে হত্যার ঘটনা, যে তিন ব্যক্তি নিজেদের উপর কড়াকড়ি আরোপ ও ঘর-সংসার ত্যাগের সংকল্প করেছিল তাদের ঘটনা ইত্যাদি। দ্রুত সংশোধনের ব্যবস্থা না নিলে ভুল সংশোধনের সুযোগ অনেক সময় হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিক সংশোধনে যে উপকারিতা পাওয়ার কথা তা আর মেলে না। অনেক সময় সংশোধনের সুযোগ চলে যায়, উপলক্ষ নস্যাৎ হয়ে যায়, ঘটনা ঠান্ডা মেরে যায় এবং বিলম্ব হেতু তার প্রতিক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে।
২. বিধান বর্ণনার মাধ্যমে ভুলের প্রতিকার :
জারহাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, أَنَّ النَّبِىَّ مََرَّ بِهِ وَهُوَ كَاشِفٌ عَنْ فَخِذِهِ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم غَطِّ فَخِذَكَ فَإِنَّهَا مِنَ الْعَوْرَةِ- ‘নবী করীম (ছাঃ) তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর উরু খোলা ছিল। তা দেখে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমার উরু ঢেকে রাখ। কেননা উরু সতরের অন্তর্ভুক্ত’।[11]
৩. ভুলকারীদের শরী‘আতের দিকে ফিরিয়ে আনা এবং যে মূলনীতির তারা খেলাফ করেছে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া :
পাপ-পংকিলতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়লে এবং উদ্ভূত অবস্থায় জড়িয়ে গেলে মানুষের মন-মগয থেকে শরী‘আতের অনেক বিধি-বিধান গায়েব হয়ে যায়। অনেক সময় সংঘাতে জড়িয়ে তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। এমন পুনঃপুনঃ মূলনীতির ঘোষণা দিলে এবং শরী‘আতের বিধি উচ্চৈঃস্বরে বললে যারা ভুল করেছে তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে এবং যে উদাসীনতা দেখা দিয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। মুনাফিকরা আনছার ও মুহাজিরদের মধ্যে ফিৎনার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ায় তাদের মাঝে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে চলেছিল তা নিয়ে চিন্তা করলে আমরা উল্লিখিত বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর গৃহীত দৃষ্টান্ত বুঝতে পারব।
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর ছহীহ গ্রন্থে জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
غَزَوْنَا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ ثَابَ مَعَهُ نَاسٌ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ حَتَّى كَثُرُوْا، وَكَانَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ رَجُلٌ لَعَّابٌ فَكَسَعَ أَنْصَارِيًّا، فَغَضِبَ الأَنْصَارِىُّ غَضَبًا شَدِيدًا، حَتَّى تَدَاعَوْا، وَقَالَ الأَنْصَارِىُّ يَا لَلأَنْصَارِ. وَقَالَ الْمُهَاجِرِىُّ يَا لَلْمُهَاجِرِينَ. فَخَرَجَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : مَا بَالُ دَعْوَى أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ. ثُمَّ قَالَ : مَا شَأْنُهُمْ. فَأُخْبِرَ بِكَسْعَةِ الْمُهَاجِرِىِّ الأَنْصَارِىَّ قَالَ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم دَعُوهَا فَإِنَّهَا خَبِيْثَةٌ-
‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। মুহাজিরদের মধ্যে বহু সংখ্যক লোক তাঁর পাশে জমা হয়েছিল। ফলে তারা সংখ্যায় বেশী হয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে মুহাজিরদের মাঝে একজন বড়ই কৌতুকবায ছিল। সে একজন আনছারীর পশ্চাৎদেশে কৌতুক করে আঘাত করে। এতে ঐ আনছারী ভীষণ রেগে যায়। তখন দু’পক্ষই নিজেদের লোকদের ডাকাডাকি আরম্ভ করে। আনছারী বলে, ওহে আনছারগণ! আমার সাহায্যে এগিয়ে এসো। মুহাজির বলে, ওহে মুহাজিরগণ! আমার সাহায্যে এগিয়ে এসো। এমতাবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) বেরিয়ে এসে বললেন, জাহিলিয়াতপন্থীদের ডাকাডাকির মত ডাকাডাকি কেন? তারপর তিনি তাদের মধ্যে কী ঘটেছে তা জানতে চাইলেন। তাঁকে মুহাজির কর্তৃক আনছারীর পশ্চাৎদেশে আঘাত করার কথা জানানো হ’ল। তিনি বললেন, এ কাজ (তামাশা করে কাউকে কিছু বলা কিংবা আঘাত করা এবং গোত্রের সাহায্য নিয়ে অবৈধ সংঘাতের জন্য আহবান) ত্যাগ কর। কেননা এটা খুবই কদর্য’।[12]
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, وَلْيَنْصُرِ الرَّجُلُ أَخَاهُ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُوْمًا إِنْ كَانَ ظَالِمًا فَلْيَنْهَهُ فَإِنَّهُ لَهُ نَصْرٌ وَإِنْ كَانَ مَظْلُوْمًا فَلْيَنْصُرْهُ ‘মানুষ যেন তার ভাইকে সাহায্য করে চাই সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত হোক। যদি সে অত্যাচারী হয় তাহ’লে তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখবে। এটাই হবে তার জন্য সাহায্য। আর যদি অত্যাচারিত হয়, তাহ’লে অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে তাকে সাহায্য করবে’।[13]
৪. ধারণায় ত্রুটির কারণে যে ভুল ধরা পড়ে সেখানে ধারণার সংশোধন :
ছহীহ বুখারীতে হুমাইদ বিন আবু হুমাইদ আত-তাবীল থেকে বর্ণিত, তিনি আনাস বিন মালিক (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন,
جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوْتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُوْنَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوْا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوْهَا فَقَالُوْا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ. قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّى أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدً. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُوْمُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ. وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا. فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّىْ لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّىْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ-
‘তিন জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ী গিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে জানতে চান! তাদেরকে তা জানানো হ’লে মনে হ’ল যেন তারা তা অল্প গণ্য করল। তারা বলাবলি করল, কোথায় নবী করীম (ছাঃ) আর কোথায় আমরা? তাঁর তো আগে-পরের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের একজন বলল, আমি রাতে সারাক্ষণ ছালাতে রত থাকব। আরেকজন বলল, আমি সারা বছর ছিয়াম পালন করব, কখনই তা ভঙ্গ করব না। অন্যজন বলল, আমি নারী সংশ্রব ত্যাগ করব; কোনদিন বিয়ে করব না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কাছে এসে বললেন, তোমরাই তো তারা, যারা এমন এমন কথা বলেছ? শোন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাদের তুলনায় আল্লাহ তা‘আলাকে বেশী ভয় করি। কিন্তু আমি ছিয়াম পালন করি, আবার বিরতিও দেই; ছালাত আদায় করি, আবার ঘুমাই এবং বিয়ে-শাদীও করেছি’।[14]
মুসলিমের বর্ণনায় আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে,
أَنَّ نَفَرًا مِنْ أَصْحَابِ النبِي صلى الله عليه وسلم سَأَلُوا أَزْوَاجَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم عَنْ عَمَلِهِ فِى السِّرِّ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ أَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ آكُلُ اللَّحْمَ. وَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ أَنَامُ عَلَى فِرَاشٍ. فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ. فَقَالَ : مَا بَالُ أَقْوَامٍ قَالُوا كَذَا وَكَذَا لَكِنِّى أُصَلِّى وَأَنَامُ وَأَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى-
‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কতিপয় ছাহাবী তাঁর স্ত্রীদের নিকট গিয়ে নির্জন মুহূর্তে তাঁর আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তা জানার পর তাদের একজন বলল, আমি বিয়ে-শাদী করব না। অন্যজন বলল, আমি গোশত খাব না। আরেকজন বলল, আমি বিছানায় ঘুমাব না। এসব কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর বললেন, ঐসব লোকের কী হ’ল যারা এমন এমন কথা বলে? আমি তো নফল ছালাত আদায় করি, ঘুমাই, ছাওম পালন করি আবার বাদ দেই। নারীদের বিয়ে-শাদীও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাতের প্রতি অনাসক্তি দেখাবে সে আমার দলভুক্ত থাকবে না’।[15]
আমরা এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে পারি :
(১) নবী করীম (ছাঃ) তাদের ও তাঁর মাঝে সংঘটিত বিষয়ে খোদ তাদের কাছে এসে সরাসরি তাদের উপদেশ দিয়েছেন। তবে তিনি যখন সাধারণভাবে সকলকে উপদেশ দিতে চাইতেন, তখন লোকদের কী হয়েছে... এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার করতেন। নাম উল্লেখ করে কাউকে ছোট করতেন না। এতে ছাহাবীদের প্রতি তাঁর স্নেহশীলতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি তাদের নামও অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে। আবার সাধারণভাবে জানানোর উদ্দেশ্যও হাছিল হচ্ছে।
(২) হাদীছে বড়দের আমলের অবস্থা জানার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়- এতে উদ্দেশ্য তাঁদের আমলের মত আমল করা এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। আবার তাদের আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে সঠিক পথে পরিচালিত করা যেমন পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয়, তেমনি তাদের আত্মার পরিচর্যাও করা হয়।
(৩) উপকারী ও শরী‘আতসম্মত যে সকল বিষয় পুরুষদের থেকে জানা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়, সেগুলোর অনুসন্ধান নারীদের কাছে করা যায়।
(৪) ব্যক্তি বিশেষের নিজের আমলের কথা অন্যদের বলাতে কোন দোষ হবে না- যখন ব্যক্তি লোক দেখানো কাজ করছে না মর্মে নিশ্চিত হবে এবং তাতে অন্যদেরও উপকার হবে।
(৫) ইবাদতে অতিরঞ্জন মনের মধ্যে বিরক্তি ও ক্লান্তির জন্ম দেয়, ফলে মূল ইবাদতই এক সময় আর করা হয়ে ওঠে না। সব ক্ষেত্রেই আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উচিত।[16]
(৬) সাধারণতঃ ধ্যান-ধারণার ত্রুটি থেকে ভুল-ভ্রান্তির জন্ম হয়। সুতরাং ধ্যান-ধারণা সঠিক হ’লে ভুলের মাত্রা অবশ্যই কমে যাবে। উক্ত হাদীছ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়- বর্ণিত ছাহাবীদের সংসার ত্যাগ, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ এবং কঠোর সাধনার ইচ্ছা জেগেছিল তাদের এই ভাবনা থেকে যে, আখিরাতে মুক্তি পেতে হ’লে তাদের নবী করীম (ছাঃ) থেকে অনেক বেশী ইবাদত করতে হবে। কেননা তাঁকে তো তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে; যা তাদের জানানো হয়নি। এমতাবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) তাদের ভুল ধারণা সংশোধন করে দেন। তিনি বুঝিয়ে দেন যে, তাদের ধারণা সঠিক পথ থেকে এক পেশে হয়ে গেছে। সঠিক ধারণা এই যে, যদিও আল্লাহ তাঁর নবীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও আল্লাহকে তিনিই সবচেয়ে বেশী ভয় করেন, তাক্বওয়াও তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী।
সুতরাং আল্লাহকে ভয় করতে এবং তার ক্ষমা পেতে চাইলে নবীর আদর্শ থেকে উন্নত আদর্শ আর কোনটাই হ’তে পারে না। সেজন্য তিনি সবাইকে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে এবং তাঁর পদ্ধতিতে ইবাদত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর কাছাকাছি আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল কাহমাস আল-হিলালী নামক একজন ছাহাবীর ক্ষেত্রে। তিনি নিজে বলেছেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে আমার মুসলিম হওয়ার কথা তাঁকে জানালাম। ইতিমধ্যে এক বছর কেটে গেল। এ সময় আমি কাহিল হয়ে পড়ি এবং আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বছর শেষে আমি তাঁর কাছে এলে তিনি একবার চোখ নিচু করে আমাকে দেখেন, আবার চোখ তুলে ধরেন। আমি বললাম, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? তিনি বললেন, তুমি কে? আমি বললাম, আমি কাহমাস আল-হিলালী। তিনি বললেন, তোমার এ বেহাল দশা কেন? আমি বললাম, আপনার নিকট থেকে যাওয়ার পর আমি একদিনও ছাওম পালন বাদ দেইনি এবং এক রাতও ঘুমাইনি। তিনি বললেন, তোমার দেহকে এমন শাস্তি দিতে কে আদেশ দিয়েছে? তুমি বরং ধৈর্যের (রামাযান) মাস এবং প্রত্যেক মাসে একদিন ছাওম রাখ। আমি বললাম, আমাকে বাড়িয়ে দিন। তিনি বললেন, ধৈর্যের মাস আর প্রত্যেক মাসে দু’দিন। আমি বললাম, আমাকে আরও বাড়িয়ে দিন, আমার সামর্থ্য আছে। তিনি বললেন, ধৈর্যের মাস এবং প্রত্যেক মাসে তিন দিন রাখ’।[17]
মানুষের মর্যাদা নির্ণয়েও অনেক সময় ধারণাগত ভ্রান্তি হয়। এরূপ ভুল সংশোধনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আগ্রহী ছিলেন। ছহীহ বুখারীতে সাহল ইবনু সা‘দ আস-সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
مَرَّ رَجُلٌ عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لِرَجُلٍ عِنْدَهُ جَالِسٍ مَا رَأْيُكَ فِى هَذَا. فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ أَشْرَافِ النَّاسِ، هَذَا وَاللهِ حَرِىٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ يُنْكَحَ، وَإِنْ شَفَعَ أَنْ يُشَفَّعَ. قَالَ فَسَكَتَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ مَرَّ رَجُلٌ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا رَأْيُكَ فِى هَذَا. فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ هَذَا رَجُلٌ مِنْ فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِينَ، هَذَا حَرِىٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ لاَ يُنْكَحَ، وَإِنْ شَفَعَ أَنْ لاَ يُشَفَّعَ، وَإِنْ قَالَ أَنْ لاَ يُسْمَعَ لِقَوْلِهِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هَذَا خَيْرٌ مِنْ مِلْءِ الأَرْضِ مِثْلَ هَذَا-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে এক ব্যক্তি গেল। তিনি তাঁর পাশে বসা একজনকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কী মত? সে বলল, ইনি তো একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ। আল্লাহর কসম! ইনি কোন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে এর সাথে মেয়ে বিয়ে দিবে। ইনি কোন সুফারিশ করলে সে সুফারিশ গ্রহণ করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার কথায় কোন কিছু না বলে চুপ থাকলেন। কিছুক্ষণ পর আরেকজন লোক গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এ একজন দরিদ্র মুসলিম। সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবে না। সে সুফারিশ করলে তার সুফারিশও গ্রহণ করা হবে না। সে কথা বললে তা শোনা হবে না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই যে লোকটা গেল সে আগের লোকটার মত জগৎভরা লোকের থেকেও অনেক শ্রেয়’।[18]ইবনু মাজাহর বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে একজন লোক গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই লোক সম্পর্কে তোমরা কী বল? তারা বললেন, আমরা তো বলি, ইনি একজন অভিজাত লোক। ইনি এতটাই উপযুক্ত যে, বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে প্রস্তাব গ্রহণ করা চলে, সুফারিশ করলে সে সুফারিশ মেনে নেয়া যায়, আর যদি কথা বলেন, তবে তা কান লাগিয়ে শোনা চলে। নবী করীম (ছাঃ) (কোন মন্তব্য না করে) চুপ করে থাকলেন। পরে আরেকজন লোক গেল। তার সম্বন্ধে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এর সম্পর্কে তোমরা কী বল? তারা বললেন, ইনি একজন দরিদ্র মুসলিম। ইনি এমন যে, বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না; কোন সুফারিশ করলে সে সুফারিশ রক্ষা করা চলে না এবং কোন কথা বললে তা শোনার যোগ্য হবে না। এবার নবী করীম (ছাঃ) মন্তব্য করলেন, অথচ এই (দরিদ্র মুসলিম) লোকটা ঐ (অভিজাত) লোকের মত দুনিয়া ভরা লোকের থেকেও শ্রেষ্ঠ’।[19]
[চলবে]
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি পর্ব ৩
✍ মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
✍ মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[1]. মুসলিম হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/৩২৩৯।
[2]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫১৮৬।
[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৮৯০, ৯/২৫৪ পৃঃ।
[4]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫৮০৯।
[5]. আবুবকর (রাঃ) ছিলেন প্রথম সারির নেক্কার মানুষ। তাকে নিষেধের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ একটি কথাই যথেষ্ট মনে করেছেন। অন্যদের বেলায় হয়তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিষেধের মাত্রা এত অল্প হ’ত না। অনুবাদক। আবুদাঊদ ‘মানাসিক’ অধ্যায় হা/১৮১৮, আলবানী সনদ হাসান।
[6]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩০৭২।
[7]. আল-মু‘জামুল কাবীর ২৪/২৮১; হায়ছামী বলেন, এর সনদ হাসান, মাজমাউয যায়ায়েদ ১/২৬৯।
[8]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫৩৭৬; মুসলিম হা/২০২২; মিশকাত হা/৪১৫৯।
[9]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০২, সনদ হাসান ছহীহ।
[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৬৮২, আলবানী হাদীছটির টীকায় বলেছেন, এটি হাসান; মুসনাদ ২/২৪৬ নং দ্রষ্টব্য। আহমাদ শাকের মুসনাদের টিকায় হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, হা/৭৩৫০।
[11]. তিরমিযী হা/২৭৯৬, তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, হাদীছটি হাসান।
[12]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩৫১৮।
[13]. মুসলিম হা/২৫৮৪।
[14]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫।
[15]. মুসলিম হা/১৪০১।
[16]. ফাৎহুল বারী ৯/১০৪ পৃঃ।
[17]. মুসনাদে ত্বয়ালিসী, ত্বাবারানী কাবীর ১৯/১৯৪, হা/৪৩৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬২৩।
[18]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৪৪৭; মিশকাত হা/৫২৩৬।
[19]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১২০, সনদ ছহীহ।
[2]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫১৮৬।
[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৮৯০, ৯/২৫৪ পৃঃ।
[4]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫৮০৯।
[5]. আবুবকর (রাঃ) ছিলেন প্রথম সারির নেক্কার মানুষ। তাকে নিষেধের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ একটি কথাই যথেষ্ট মনে করেছেন। অন্যদের বেলায় হয়তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিষেধের মাত্রা এত অল্প হ’ত না। অনুবাদক। আবুদাঊদ ‘মানাসিক’ অধ্যায় হা/১৮১৮, আলবানী সনদ হাসান।
[6]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩০৭২।
[7]. আল-মু‘জামুল কাবীর ২৪/২৮১; হায়ছামী বলেন, এর সনদ হাসান, মাজমাউয যায়ায়েদ ১/২৬৯।
[8]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫৩৭৬; মুসলিম হা/২০২২; মিশকাত হা/৪১৫৯।
[9]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০২, সনদ হাসান ছহীহ।
[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৬৮২, আলবানী হাদীছটির টীকায় বলেছেন, এটি হাসান; মুসনাদ ২/২৪৬ নং দ্রষ্টব্য। আহমাদ শাকের মুসনাদের টিকায় হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, হা/৭৩৫০।
[11]. তিরমিযী হা/২৭৯৬, তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, হাদীছটি হাসান।
[12]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৩৫১৮।
[13]. মুসলিম হা/২৫৮৪।
[14]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫।
[15]. মুসলিম হা/১৪০১।
[16]. ফাৎহুল বারী ৯/১০৪ পৃঃ।
[17]. মুসনাদে ত্বয়ালিসী, ত্বাবারানী কাবীর ১৯/১৯৪, হা/৪৩৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬২৩।
[18]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৪৪৭; মিশকাত হা/৫২৩৬।
[19]. ইবনু মাজাহ, হা/৪১২০, সনদ ছহীহ।