- Joined
- Jul 31, 2024
- Messages
- 102
- Reaction score
- 3
প্রথম পর্বে যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা হলো রহমান কি আরশের উপরে উঠেছেন?
ইস্তেওয়া শব্দটি কুরআন ও সুন্নাহ'র যেখানে যেখানে এসেছে সেখানে দু'টি নিয়ম থেকে মুক্ত নয়: এক. উন্মুক্তভাবে আসা, অর্থাৎ ইস্তেওয়ার সাথে অর্থে পরিবর্তন আনয়নকারী কোনো অব্যয় যোগ করা হয়নি। তখন তার অর্থ হবে, পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমে বলেছেন,
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَى
“আর যখন তিনি তার শক্তিসামর্থ্যে পৌঁছলেন এবং পূর্ণতা প্রাপ্ত হলেন।” [সূরা আলা- কাসাস, আয়াত: ১৪]
দুই. উন্মুক্তভাবে না আসা, অর্থাৎ ইস্তেওয়ার সাথে অর্থে পরিবর্তন আনয়নকারী কোনো অব্যয় যুক্ত হয়ে আসা। তখন তার তিন অবস্থা হতে পারে:
প্রথম অবস্থা: إلى যুক্ত হয়ে আসা। তখন ‘ইস্তেওয়া’ এর দু'টি অর্থ করা হয়ে থাকে:
এক. ইচ্ছা করা এবং এগিয়ে যাওয়া। এ অর্থটি ইবন কাসীর তার তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। [১/২১৩]
দুই. উপরে উঠা, যা রবী ইবন আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, আর ইমাম ইবন জারীর পছন্দ করেছেন। [১/৪৬৫-৪৫৭] অনুরূপ ইবন আবী হাতেম [১/৭৫] আর এ অর্থটি ইবনুল কাইয়্যেম তার মুখতাসারুস সাওয়ায়িকে করেছেন এবং তিনি এটার ওপর ভাষাবিদদের ইজমা' বর্ণনা করেছেন। [২/১২৬-১২৭]
কুরআনে কারীমে এ রকম দু'টি আয়াত এসেছে,
১. আল্লাহ তা'আলা বলেন,
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ
“তারপর তিনি আকাশের উপর উঠলেন।” [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৯]
২. অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেন,
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانُ
“তারপর তিনি আকাশের উপর উঠলেন আর এটা ছিল ধোঁয়া।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১১] বস্তুত তখন উপরে উঠা এবং ইচ্ছা করা দু'টি অর্থই হয়। যদিও বেশিরভাগ মুফাসসির প্রথম অর্থটি করেছেন এবং সেটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অবস্থা: واو দিয়ে সেটা কোনো কিছুর সাথে থাকার কর্মবাচ্য مفعول معه হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। তখন ‘ইস্তেওয়ার অর্থ হয়, কোনো কিছু সমান সমান হওয়া। যেমন আরবী ভাষায় বলা হয়, استوى الماء والخشبة অর্থাৎ “পানি ও কাঠ সমপর্যায়ে আছে”।
তৃতীয় অবস্থা: على দিয়ে ব্যবহৃত হওয়া। তখন তার অর্থ হয়:
১. উপরে উঠা। আরবীতে তা তিনটি শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।
এক. ارتفع উপরে উঠা। আর বিশর ইবন ‘উমার ইবনুল হিকাম আয-যাহরানী আল-আযদী বলেন, আমি একাধিক মুফাসসিরদের থেকে তা শুনেছি। তারা সেটাকে আবুল ‘আলীয়া থেকে বর্ণনা করেছেন। তা ইমাম বুখারী তার সহীহতে মু'আল্লাক নিয়ে এসেছেন। কিতাবুত তাওহীদে [৯/২২১] অনুরূপভাবে তা ইমাম ইবন জারীর আত-ত্বাবারীও বর্ণনা করেছেন। [৮/১৩৮; সূরা ত্বা-হা এর আয়াতের তাফসীরে] তাছাড়া তা রবী' ইবন আনাস থেকেও বর্ণিত ।(১)
দুই. علا উপরে উঠা। আর তা মুজাহিদ ইবন জাবর রাহিমাহুল্লাহ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী তার সহীহতে তা মু'আল্লাক হিসেবে নিয়ে এসেছেন। কিতাবুত তাওহীদ [৯/২২১] যা ফিরইয়াবী তার কিতাবে সনদসহ বর্ণনা করেছেন।(২) অনুরূপভাবে তা ভাষাবিদ আবুল ‘আব্বাস সা‘লাব বলেছেন।(৩) অনুরূপভাবে তা ইমাম ইবন জারীর আত-ত্বাবারীও বর্ণনা করেছেন।(৪)
তিন. صعد উপরে উঠা। ইমাম বাগাওয়ী তা আবু উবাইদাহ মা'মার ইবনুল মুসান্না থেকে বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম বাইহাকী সনদসহ তা ইবন ‘আব্বাস থেকে আবু সালেহ ও কালবীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন, সূরা আল-বাক্বারাহ এর আয়াতের তাফসীরে।(৫)
‘ইস্তেওয়া’ শব্দের অর্থে এ তিনটি প্রতিশব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে সকল সালাফে সালেহীনের ঐকমত্য আমরা লক্ষ্য করি। আর তা বিভিন্ন ভাষাবিদরাও উল্লেখ করে থাকেন।
ইস্তেওয়া এর সাথে على যুক্ত হওয়ার সাথে আরও কিছু অর্থ ও তার সমাধান :
এছাড়াও ‘ইস্তেওয়া’ শব্দের সাথে যখন على যুক্ত হয়, তখন ‘ইস্তেওয়া’ এর আরও দু'টি প্রতিশব্দের ব্যবহার দেখতে পাই, যা সরাসরি অর্থের চেয়েও একটু বেশি সাব্যস্ত করে। সে দু'টি শব্দ হচ্ছে,
২. استقر উপরে উঠা ও সেখানে থাকা বা অবস্থান করা। ইমাম বাগাওয়ী কালবী ও মুকাতিল থেকে বর্ণনা করেছেন।(৬) বস্তুত এ অর্থটি আগের তিনটি প্রতিশব্দের চেয়ে বেশি ব্যাপক অর্থ প্রদান করে। কারণ আগের তিনটি প্রতিশব্দ শুধু এটাই বুঝাতো যে, আল্লাহ তা'আলা ‘আরশের উপর উঠেছেন। কিন্তু استقر বলা হলে তার অর্থ হয়, ‘আরশের উপর উঠা এবং সেখানে থাকা।(৭) তবে মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত এ অর্থটিও সাব্যস্ত করে থাকেন। কারণ এ অর্থের সমর্থনে বহু হাদীস বিদ্যমান।
পরবর্তী কোনো কোনো আলেম এ অর্থটি অস্বীকার করেছেন। [শাইখ আবু আবদুর রহমান মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দীন আল-আলবানী তার মুখতাসারুল ‘উলু গ্রন্থে, শাইখ বকর আবু যাইদ, মু'জামুল মানাহিল লাফযিয়্যাহ গ্রন্থে] তাদের অস্বীকারের মূল কারণ দু'টি:
এক. এ শব্দে সরাসরি কোনো আয়াত বা হাদীস না আসা।
দুই. আরবী ভাষাবিদদের নিকট এ শব্দের আরেকটি অর্থ আরামের সাথে স্থির হওয়া।(৮) আর আল্লাহর জন্য এমন একটি জিনিস সাব্যস্ত করতে হলে সরাসরি দলীল লাগবে। সেটা তাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি বলেই তারা সেটা স্বীকার করার ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বস্তুত এ ব্যাপারে তাদের ওযর রয়েছে, তারা কখনো সেসব মু‘আত্তিলা বা আল্লাহর গুণকে অর্থশূন্যকারীর দলের লোক নয়। তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের লোক; তারা শুধু সে অর্থটি প্রমাণিত হওয়া কিংবা শব্দটির অপর যে অর্থটি প্রচলিত আছে সেটা সাব্যস্ত করা নিয়ে মতভেদ করেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে কোনো কোনো নব্য জাহমিয়্যার কথা বলার কিছু নেই । যুগ যুগ ধরেই আলেমগণ কোনো শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু তারা মৌলিকভাবে আল্লাহর জন্য ‘আরশের উপর উঠা এবং ‘আরশের উপর আমাদের রবের থাকার বিষয়টি বিশ্বাস করে থাকেন।
কিন্তু যারা আরবী ভাষাবিদ তারা এ অর্থটিকে সাব্যস্ত করেছেন, ফলে দেখা যায় এ অর্থটি অনেক মুফাসসির ও অনেক ভাষাবিদ বর্ণনা করেছেন। যেমন,
• আবুল ফাতহ সুলাইম ইবন আইয়্যূব আর-রাযী (৪৪৭ হিজরী)।(৯)
• অনুরূপভাবে ইমাম ইবন আবদুল বার (৪৬৩ হিজরী) তার তামহীদ গ্রন্থে বলেছেন, الا ستقرار في العلى هذا خاطبنا الله عزْ وجلّ “ইস্তেওয়া হচ্ছে উপরে অবস্থান করা, আর এটাই আমাদেরকে আল্লাহ জানিয়েছেন।(১০)
• শাইখুল ইসলাম আল-আনসারী আল-হারওয়ী (৪৮১ হিজরী)।
• ইমাম বাগাওয়ী (৫১০ হিজরী) কালবী ও মুকাতিল থেকে বর্ণনা করেছেন।(১১)
• আবু আহমাদ আল-কারজী (৫৩২ হিজরী)।(১২) তিনি খলীফা আল-কাদের বিল্লাহ (৪২২ হিজরী) থেকে যে আকীদাহ বর্ণনা করেন, যা “আল-ই'তিক্বাদুল কাদেরী” নামে খ্যাত, তাতে এসেছে,
كان ربنا عزّ وجلّ واحد لا شيء معه، ولا مكان يحويه، فخلق كل شيء بقدرته، وخلق العرش لا لحاجة إلبه، فاستوى عليه استواء كيف شاء وأراد، لا استقرار راحة كما يستريح الخلق
“আমাদের মহান রব তিনি এক, তাঁর সাথে আর কেউ নেই, কোনো স্থান তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তার ক্ষমতা বলে, আর ‘আরশও তিনি সৃষ্টি করেছেন তবে সেটার প্রতি তাঁর কোনো প্রয়োজনের কারণে নয়, তারপর তিনি তার উপর উঠেছেন, সেখানে অবস্থানের জন্য উপরে উঠা, যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেছেন ও চেয়েছেন, তবে আরাম করার জন্য অবস্থান করা নয় যেমনটি সৃষ্টিকুল আরাম করার জন্য অবস্থান করে থাকে।”(১৩)
• অনুরূপভাবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (৭২৮ হিজরী) রাহিমাহুল্লাহও তাঁর শারহু হাদীসুন নুযূল গ্রন্থে এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন।(১৪)
তাছাড়া দারউ তা'আরাদুল আকলি ওয়ান নাকলি গ্রন্থে তিনি সুলতান মাহমূদ সবুক্তগীনের আকীদাহ বর্ণনা করতে গিয়েও তা বর্ণনা করেছেন। সেখানে এসেছে,
فاستوى على استواء استقرار كيف شاء وأراد لا استقرار راحة كما يستريح الخلق
“তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন, আর তাতে অবস্থান করেছেন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেছেন এবং চেয়েছেন; তবে কোনোভাবেই আরাম করার জন্য বলা যাবে না, যেমনটি মানুষ আরাম করে থাকে।”(১৫)
• অনুরূপভাবে ইবনুল কাইয়্যেম (৭৫১ হিজরী) রাহিমাহুল্লাহও তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে এটিকে কোনো প্রকার বিরোধিতা ছাড়াই বর্ণনা করেছেন।(১৬)
فَلهم عِبَارَات عَلَيْهَا أَربع *** قد حصلت للفارس الطعان
وَهِي اسْتَقر وَقد علا وَكَذَلِكَ ارتفع الَّذِي مَا فِيهِ من نكران
. وكذاك قد صعد الَّذِي هُوَ رَابع وَأَبو عُبَيْدَة صَاحب ا ب الشَّيْبَانِيّ
يختار هَذَا القَوْل فِي تَفْسِيره *** أَدْرِي من الجهمي بِالْقُرْآنِ .
“তাদের এ ব্যাপারে চারটি প্রতিশব্দ; যা এ ময়দানের সাওয়ারীর অর্জিত হয়েছে, আর তা হচ্ছে, (ইস্তাক্কাররা) উপরে অবস্থান করা, উপরে উঠা, অনুরূপ ঊর্ধ্বে উঠা, যাতে কোনো সমস্যা নেই।
অনুরূপ “উপরে আরোহণ করা”, যা চতুর্থ অর্থ। আর ইমাম আবু আবদুল্লাহ আশ-শাইবানীর ছাত্র তার তাফসীরে এ অর্থগুলো পছন্দ করেছেন। তিনি অবশ্যই জাহমী থেকে কুরআন সম্পর্কে ভালো জানেন।”(১৭)
এ বিষয়ে আমাদের শাইখ আবদুল্লাহ আল-গুনাইমান হাফিযাহুল্লাহও আলোচনা করে তা সাব্যস্ত করেছেন।(১৮)
৩. جلس وقعد বসা বা আসীন হওয়া। এ অর্থটি কোনো কোনো সালাফদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ চারটি:
এক. ‘মাকামে মাহমূদ' এর তাফসীরে এসেছে, আল্লাহ তা'আলা তার নবীকে ‘আরশে তাঁর সাথে বসানো সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো। এ বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই দুর্বল। তবে প্রখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ ইবন জাবর রাহিমাহুল্লাহ থেকে তা বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে।
দুই. হাবশায় এক নারী নির্যাতিত হওয়া সংক্রান্ত হাদীসে সে নারী বলেছিল, “যেদিন আল্লাহ তাঁর কুরসীতে বসবেন” যা ইমাম ইবন খুযাইমাহ বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটি শুদ্ধ হওয়া না হওয়া নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে।
তিন. তাছাড়া কুরসী আল্লাহর পা রাখার স্থান সংক্রান্ত ইবন 'আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহুমার ‘আছার' থেকেও তা বুঝা যায়। এটি সহীহ সনদ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। আর তা থেকে কেউ কেউ বসার বিষয়টি ধরে নিয়েছে। কিন্তু কথার দাবি দিয়ে ধরে নেয়ার এ নীতিতে সাধারণত সিফাত সাব্যস্ত করা হয় না। এ জন্য বর্তমান সালাফী আলেমগণের কেউই এ ‘আসার' থেকে বসার বিষয়টি সাব্যস্ত করেন না।
চার. সালাফদের থেকে বেশি কিছু বর্ণনা এসেছে যার মাধ্যমে কেউ কেউ এ অর্থ সাব্যস্ত করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে শা'বীর বর্ণনায় ইবন 'আব্বাস থেকে (যা সনদের দিক থেকে কর্তিত), আবু ইসহাক আস-সাবি'ঈ, আস-সাওরী, আল-আ‘মাশ, ইসরাইল, আবদুর রহমান ইবন মাহদী, আবু আহমাদ আয-যাবীরী, ওকী', আহমাদ ইবন হাম্বল প্রমুখ থেকে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সনদই বিতর্কিত।
আর উপরোক্ত বর্ণনাগুলো সাব্যস্ত হয়েছে কি হয়নি এ ব্যাপারে মতভেদ নিয়েই এ অর্থটি সাব্যস্ত করা হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে। যারা সেগুলোকে দুর্বল বলেছেন, তারা তা সাব্যস্ত করেননি। আর যারা সেগুলোকে শক্তিশালী বলেছেন তারা তা সাব্যস্ত করেছেন।
সুতরাং তারাও মূলত আল্লাহর সিফাত সাব্যস্তকারী। তাদের সাথে প্রথম অর্থসমূহ সাব্যস্তকারীদের মধ্যে বিশ্বাসগত ও নীতিগত কোনো পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র অর্থটি দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া বা না হওয়া নিয়েই তাদের মতপার্থক্য। এ ব্যাপারে মতভেদ দেখিয়ে যেসব জাহমী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে তাদের জানা উচিত, এরা সবাই অর্থাৎ যারা এ অর্থটি সাব্যস্ত করে আর যারা সাব্যস্ত করে না, সবাই একমত যে, যদি এ ব্যাপারে হাদীস শুদ্ধ হয় তবে তারাও সেটা বলবে। তাদের কাছে আল্লাহর 'বসা' তাঁর হাত, পা, আঙ্গুল, চেহারা, চোখ, ‘আরশের উপর উঠা, প্রথম আসমানে অবতরণ, হাসা, আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে তা কোনোভাবেই বেশি নয়। তারা সবাই দলীলের ভিত্তিতেই চলে, আর দলীলের ভিত্তিতেই থামে।
এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, যা শাইখ আবদুর রহমান ইবন নাসের আস-সা'দী বলেছেন,
نثبت أنه استوى على عرشه استواء يليق بجلاله، سواء فسر ذلك بالارتفاع، أو بعلوه على عرشه، أو بالاستقرار، أو الجلوس، فهذه التفاسير واردة عن السلف، فنثبت الله على وجه لا يماثله ولا يشابهه فيها أحد، ولا محذور في ذلك إذا قرنا بهذا الإثبات نفي مماثلة المخلوقات
“আমরা আমাদের রবের ‘আরশের উঠাকে সাব্যস্ত করি, তা যেভাবে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার সাথে উপযোগী ও সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাকে যেভাবেই তাফসীর করা হোক না কেন, চাই সেটাকে উপরে উঠা বলা হোক, অথবা তাঁর ‘আরশে উপর উঠা বলা হোক, অথবা ‘আরশের উপরে অবস্থানের কথাই বলা হোক অথবা বসা বলা হোক। এসব তাফসীর সালাফদের থেকে এসেছে। আমরা সেগুলোকে এমনভাবে সাব্যস্ত করবো যা অন্য কারও মতো বা কারও সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া থেকে মুক্ত। আর এতে কোনো নিষিদ্ধ কিছু নেই, যদি এ সাব্যস্তকরণ সৃষ্টির কারও সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া থেকে মুক্ত ঘোষণা করা যায়।”(১৯)
এ হচ্ছে রাব্বুল আলামীনের ‘ইস্তেওয়া’; আরবী ভাষাতে অন্যদের জন্যেও যখন এ শব্দটি على বা إلى যোগে ব্যবহৃত হয় তখনও তা উপরে উঠা অর্থে এসেছে। এমনকি কুরআনুল কারীমেও সেভাবে মানুষের গুণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন,
فَإِذَا اسْتَوَيْتَ أَنتَ وَمَن مَّعَكَ عَلَى الْفُلْكِ فَقُلِ
“অতঃপর যখন আপনি ও আপনার সাথীরা জাহাজের উপর উঠবেন তখন বলুন ...”। [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ২৮]
لِتَسْتَوُداً عَلَى ظُهُورِهِ، ثُمَّ تَذْكُرُواْ نِعْمَةَ رَبِّكُمْ إِذَا اسْتَوَيْتُمْ عَلَيْهِ
“যাতে করে তোমরা তার পিঠের উপর উঠতে পার, তারপর তোমাদের রবের নি'আমতকে স্মরণ করতে পার যখন তোমরা তার উপর উঠবে..।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ১৩]
تُحمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ .... كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْقَهُ، فَتَازَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ، يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظُ بِهِمُ الْكُفَّار
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; আর তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর, তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কচিপাতা, তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক।” [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ১৩]
অনুরূপ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“আর তা জুদী পাহাড়ের উপর উঠলো।” [সূরা হূদ, আয়াত: ৪৪] সুতরাং বুঝা গেল যে, ‘ইস্তেওয়া’ শব্দটি যখন على বা إلى যোগে ব্যবহৃত হয়, তখন উপরে উঠার অর্থই সর্বজন স্বীকৃত।
১. ইবন আবী হাতেম (৬/১৯২৫)।
২. ইবন হাজার, তাগলীকুত তা'লীক (৫/৩৪৫)।
৩. শারহু উসুলে ই'তিকাদে আহলুস সুন্নাহ (৩/৩৯৯); যাহাবী, আল-আরবা‘ঈন ফী সিফাতে রাব্বিল ‘আলামীন, পৃ. ৩৭ ।
৪. (৮/১৩৮); সূরা ত্বা-হা এর আয়াতের তাফসীরে।
৫. আল-বাইহাক্বী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত: ৮৭২।
৬. তাফসীরে বাগাওয়ী (৩/২৩৫)।
৭. মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন, শারহুর আকীদাতিল ওয়াসেত্বিয়্যাহ: (১/৩৩৩)।
৮. ইবনুল কাইয়্যেম, আস-সাওয়া'য়িকুল মুরসালাহ ৪/১২৮৮; যাহাবী, আল-‘উলু (২/১৩০৩)।
৯. আয-যাহাবী, আল-উলু, ১৮০।
১০. আত-তামহীদ (৭/১৩১)।
১১. তাফসীরে বাগাওয়ী (৩/২৩৫)।
১২. আল-‘উলূ ২৩৯।
১৩. আল-ই'তিকাদুল কাদেরী, পৃ. ৩; আল-মুস্তাযাম (১৫/২৮০-২৮২); ইবন কাসীর, আর-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (১২/২৬-৪৯); যাহাবী, তারীখুল ইসলাম (২৮/২৬৮-২৮৬)।
১৪. শারহু হাদীসুন নুযুল, পৃ. ৩৯০।
১৫. দারউ তা'আরাছুল আকলি ওয়ান নাকলি (৬/২৫৩-২৫৪; ইবনুল কাইয়্যেম, আস-সাওয়া'য়িকুল মুরসালাহ (৪/১২৮৮)।
১৬. আন-নূনিয়া।
১৭. নূনিয়াতু ইবনিল কাইয়্যেম, কবিতার ছত্র নং ১৩৫৩-১৩৫৬।
১৮. দেখুন, শারহু কিতাবুত তাওহীদ মিন সহীহিল বুখারী (১/৩৫৬)।
১৯. আল-আজওয়িবাতুস সা‘দিয়্যাহ 'আলাল মাসায়িলিল কওয়াইতিয়্যাহ পৃ. ১৪৬।
ইস্তেওয়া শব্দটি কুরআন ও সুন্নাহ'র যেখানে যেখানে এসেছে সেখানে দু'টি নিয়ম থেকে মুক্ত নয়: এক. উন্মুক্তভাবে আসা, অর্থাৎ ইস্তেওয়ার সাথে অর্থে পরিবর্তন আনয়নকারী কোনো অব্যয় যোগ করা হয়নি। তখন তার অর্থ হবে, পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমে বলেছেন,
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَى
“আর যখন তিনি তার শক্তিসামর্থ্যে পৌঁছলেন এবং পূর্ণতা প্রাপ্ত হলেন।” [সূরা আলা- কাসাস, আয়াত: ১৪]
দুই. উন্মুক্তভাবে না আসা, অর্থাৎ ইস্তেওয়ার সাথে অর্থে পরিবর্তন আনয়নকারী কোনো অব্যয় যুক্ত হয়ে আসা। তখন তার তিন অবস্থা হতে পারে:
প্রথম অবস্থা: إلى যুক্ত হয়ে আসা। তখন ‘ইস্তেওয়া’ এর দু'টি অর্থ করা হয়ে থাকে:
এক. ইচ্ছা করা এবং এগিয়ে যাওয়া। এ অর্থটি ইবন কাসীর তার তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। [১/২১৩]
দুই. উপরে উঠা, যা রবী ইবন আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, আর ইমাম ইবন জারীর পছন্দ করেছেন। [১/৪৬৫-৪৫৭] অনুরূপ ইবন আবী হাতেম [১/৭৫] আর এ অর্থটি ইবনুল কাইয়্যেম তার মুখতাসারুস সাওয়ায়িকে করেছেন এবং তিনি এটার ওপর ভাষাবিদদের ইজমা' বর্ণনা করেছেন। [২/১২৬-১২৭]
কুরআনে কারীমে এ রকম দু'টি আয়াত এসেছে,
১. আল্লাহ তা'আলা বলেন,
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ
“তারপর তিনি আকাশের উপর উঠলেন।” [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২৯]
২. অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেন,
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانُ
“তারপর তিনি আকাশের উপর উঠলেন আর এটা ছিল ধোঁয়া।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১১] বস্তুত তখন উপরে উঠা এবং ইচ্ছা করা দু'টি অর্থই হয়। যদিও বেশিরভাগ মুফাসসির প্রথম অর্থটি করেছেন এবং সেটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অবস্থা: واو দিয়ে সেটা কোনো কিছুর সাথে থাকার কর্মবাচ্য مفعول معه হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। তখন ‘ইস্তেওয়ার অর্থ হয়, কোনো কিছু সমান সমান হওয়া। যেমন আরবী ভাষায় বলা হয়, استوى الماء والخشبة অর্থাৎ “পানি ও কাঠ সমপর্যায়ে আছে”।
তৃতীয় অবস্থা: على দিয়ে ব্যবহৃত হওয়া। তখন তার অর্থ হয়:
১. উপরে উঠা। আরবীতে তা তিনটি শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে।
এক. ارتفع উপরে উঠা। আর বিশর ইবন ‘উমার ইবনুল হিকাম আয-যাহরানী আল-আযদী বলেন, আমি একাধিক মুফাসসিরদের থেকে তা শুনেছি। তারা সেটাকে আবুল ‘আলীয়া থেকে বর্ণনা করেছেন। তা ইমাম বুখারী তার সহীহতে মু'আল্লাক নিয়ে এসেছেন। কিতাবুত তাওহীদে [৯/২২১] অনুরূপভাবে তা ইমাম ইবন জারীর আত-ত্বাবারীও বর্ণনা করেছেন। [৮/১৩৮; সূরা ত্বা-হা এর আয়াতের তাফসীরে] তাছাড়া তা রবী' ইবন আনাস থেকেও বর্ণিত ।(১)
দুই. علا উপরে উঠা। আর তা মুজাহিদ ইবন জাবর রাহিমাহুল্লাহ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী তার সহীহতে তা মু'আল্লাক হিসেবে নিয়ে এসেছেন। কিতাবুত তাওহীদ [৯/২২১] যা ফিরইয়াবী তার কিতাবে সনদসহ বর্ণনা করেছেন।(২) অনুরূপভাবে তা ভাষাবিদ আবুল ‘আব্বাস সা‘লাব বলেছেন।(৩) অনুরূপভাবে তা ইমাম ইবন জারীর আত-ত্বাবারীও বর্ণনা করেছেন।(৪)
তিন. صعد উপরে উঠা। ইমাম বাগাওয়ী তা আবু উবাইদাহ মা'মার ইবনুল মুসান্না থেকে বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম বাইহাকী সনদসহ তা ইবন ‘আব্বাস থেকে আবু সালেহ ও কালবীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন, সূরা আল-বাক্বারাহ এর আয়াতের তাফসীরে।(৫)
‘ইস্তেওয়া’ শব্দের অর্থে এ তিনটি প্রতিশব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে সকল সালাফে সালেহীনের ঐকমত্য আমরা লক্ষ্য করি। আর তা বিভিন্ন ভাষাবিদরাও উল্লেখ করে থাকেন।
ইস্তেওয়া এর সাথে على যুক্ত হওয়ার সাথে আরও কিছু অর্থ ও তার সমাধান :
এছাড়াও ‘ইস্তেওয়া’ শব্দের সাথে যখন على যুক্ত হয়, তখন ‘ইস্তেওয়া’ এর আরও দু'টি প্রতিশব্দের ব্যবহার দেখতে পাই, যা সরাসরি অর্থের চেয়েও একটু বেশি সাব্যস্ত করে। সে দু'টি শব্দ হচ্ছে,
২. استقر উপরে উঠা ও সেখানে থাকা বা অবস্থান করা। ইমাম বাগাওয়ী কালবী ও মুকাতিল থেকে বর্ণনা করেছেন।(৬) বস্তুত এ অর্থটি আগের তিনটি প্রতিশব্দের চেয়ে বেশি ব্যাপক অর্থ প্রদান করে। কারণ আগের তিনটি প্রতিশব্দ শুধু এটাই বুঝাতো যে, আল্লাহ তা'আলা ‘আরশের উপর উঠেছেন। কিন্তু استقر বলা হলে তার অর্থ হয়, ‘আরশের উপর উঠা এবং সেখানে থাকা।(৭) তবে মৌলিকভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত এ অর্থটিও সাব্যস্ত করে থাকেন। কারণ এ অর্থের সমর্থনে বহু হাদীস বিদ্যমান।
পরবর্তী কোনো কোনো আলেম এ অর্থটি অস্বীকার করেছেন। [শাইখ আবু আবদুর রহমান মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দীন আল-আলবানী তার মুখতাসারুল ‘উলু গ্রন্থে, শাইখ বকর আবু যাইদ, মু'জামুল মানাহিল লাফযিয়্যাহ গ্রন্থে] তাদের অস্বীকারের মূল কারণ দু'টি:
এক. এ শব্দে সরাসরি কোনো আয়াত বা হাদীস না আসা।
দুই. আরবী ভাষাবিদদের নিকট এ শব্দের আরেকটি অর্থ আরামের সাথে স্থির হওয়া।(৮) আর আল্লাহর জন্য এমন একটি জিনিস সাব্যস্ত করতে হলে সরাসরি দলীল লাগবে। সেটা তাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি বলেই তারা সেটা স্বীকার করার ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বস্তুত এ ব্যাপারে তাদের ওযর রয়েছে, তারা কখনো সেসব মু‘আত্তিলা বা আল্লাহর গুণকে অর্থশূন্যকারীর দলের লোক নয়। তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের লোক; তারা শুধু সে অর্থটি প্রমাণিত হওয়া কিংবা শব্দটির অপর যে অর্থটি প্রচলিত আছে সেটা সাব্যস্ত করা নিয়ে মতভেদ করেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে কোনো কোনো নব্য জাহমিয়্যার কথা বলার কিছু নেই । যুগ যুগ ধরেই আলেমগণ কোনো শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু তারা মৌলিকভাবে আল্লাহর জন্য ‘আরশের উপর উঠা এবং ‘আরশের উপর আমাদের রবের থাকার বিষয়টি বিশ্বাস করে থাকেন।
কিন্তু যারা আরবী ভাষাবিদ তারা এ অর্থটিকে সাব্যস্ত করেছেন, ফলে দেখা যায় এ অর্থটি অনেক মুফাসসির ও অনেক ভাষাবিদ বর্ণনা করেছেন। যেমন,
• আবুল ফাতহ সুলাইম ইবন আইয়্যূব আর-রাযী (৪৪৭ হিজরী)।(৯)
• অনুরূপভাবে ইমাম ইবন আবদুল বার (৪৬৩ হিজরী) তার তামহীদ গ্রন্থে বলেছেন, الا ستقرار في العلى هذا خاطبنا الله عزْ وجلّ “ইস্তেওয়া হচ্ছে উপরে অবস্থান করা, আর এটাই আমাদেরকে আল্লাহ জানিয়েছেন।(১০)
• শাইখুল ইসলাম আল-আনসারী আল-হারওয়ী (৪৮১ হিজরী)।
• ইমাম বাগাওয়ী (৫১০ হিজরী) কালবী ও মুকাতিল থেকে বর্ণনা করেছেন।(১১)
• আবু আহমাদ আল-কারজী (৫৩২ হিজরী)।(১২) তিনি খলীফা আল-কাদের বিল্লাহ (৪২২ হিজরী) থেকে যে আকীদাহ বর্ণনা করেন, যা “আল-ই'তিক্বাদুল কাদেরী” নামে খ্যাত, তাতে এসেছে,
كان ربنا عزّ وجلّ واحد لا شيء معه، ولا مكان يحويه، فخلق كل شيء بقدرته، وخلق العرش لا لحاجة إلبه، فاستوى عليه استواء كيف شاء وأراد، لا استقرار راحة كما يستريح الخلق
“আমাদের মহান রব তিনি এক, তাঁর সাথে আর কেউ নেই, কোনো স্থান তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তার ক্ষমতা বলে, আর ‘আরশও তিনি সৃষ্টি করেছেন তবে সেটার প্রতি তাঁর কোনো প্রয়োজনের কারণে নয়, তারপর তিনি তার উপর উঠেছেন, সেখানে অবস্থানের জন্য উপরে উঠা, যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেছেন ও চেয়েছেন, তবে আরাম করার জন্য অবস্থান করা নয় যেমনটি সৃষ্টিকুল আরাম করার জন্য অবস্থান করে থাকে।”(১৩)
• অনুরূপভাবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ (৭২৮ হিজরী) রাহিমাহুল্লাহও তাঁর শারহু হাদীসুন নুযূল গ্রন্থে এ অর্থটি বর্ণনা করেছেন।(১৪)
তাছাড়া দারউ তা'আরাদুল আকলি ওয়ান নাকলি গ্রন্থে তিনি সুলতান মাহমূদ সবুক্তগীনের আকীদাহ বর্ণনা করতে গিয়েও তা বর্ণনা করেছেন। সেখানে এসেছে,
فاستوى على استواء استقرار كيف شاء وأراد لا استقرار راحة كما يستريح الخلق
“তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন, আর তাতে অবস্থান করেছেন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেছেন এবং চেয়েছেন; তবে কোনোভাবেই আরাম করার জন্য বলা যাবে না, যেমনটি মানুষ আরাম করে থাকে।”(১৫)
• অনুরূপভাবে ইবনুল কাইয়্যেম (৭৫১ হিজরী) রাহিমাহুল্লাহও তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে এটিকে কোনো প্রকার বিরোধিতা ছাড়াই বর্ণনা করেছেন।(১৬)
فَلهم عِبَارَات عَلَيْهَا أَربع *** قد حصلت للفارس الطعان
وَهِي اسْتَقر وَقد علا وَكَذَلِكَ ارتفع الَّذِي مَا فِيهِ من نكران
. وكذاك قد صعد الَّذِي هُوَ رَابع وَأَبو عُبَيْدَة صَاحب ا ب الشَّيْبَانِيّ
يختار هَذَا القَوْل فِي تَفْسِيره *** أَدْرِي من الجهمي بِالْقُرْآنِ .
“তাদের এ ব্যাপারে চারটি প্রতিশব্দ; যা এ ময়দানের সাওয়ারীর অর্জিত হয়েছে, আর তা হচ্ছে, (ইস্তাক্কাররা) উপরে অবস্থান করা, উপরে উঠা, অনুরূপ ঊর্ধ্বে উঠা, যাতে কোনো সমস্যা নেই।
অনুরূপ “উপরে আরোহণ করা”, যা চতুর্থ অর্থ। আর ইমাম আবু আবদুল্লাহ আশ-শাইবানীর ছাত্র তার তাফসীরে এ অর্থগুলো পছন্দ করেছেন। তিনি অবশ্যই জাহমী থেকে কুরআন সম্পর্কে ভালো জানেন।”(১৭)
এ বিষয়ে আমাদের শাইখ আবদুল্লাহ আল-গুনাইমান হাফিযাহুল্লাহও আলোচনা করে তা সাব্যস্ত করেছেন।(১৮)
৩. جلس وقعد বসা বা আসীন হওয়া। এ অর্থটি কোনো কোনো সালাফদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ চারটি:
এক. ‘মাকামে মাহমূদ' এর তাফসীরে এসেছে, আল্লাহ তা'আলা তার নবীকে ‘আরশে তাঁর সাথে বসানো সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো। এ বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই দুর্বল। তবে প্রখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ ইবন জাবর রাহিমাহুল্লাহ থেকে তা বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে।
দুই. হাবশায় এক নারী নির্যাতিত হওয়া সংক্রান্ত হাদীসে সে নারী বলেছিল, “যেদিন আল্লাহ তাঁর কুরসীতে বসবেন” যা ইমাম ইবন খুযাইমাহ বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটি শুদ্ধ হওয়া না হওয়া নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে।
তিন. তাছাড়া কুরসী আল্লাহর পা রাখার স্থান সংক্রান্ত ইবন 'আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু 'আনহুমার ‘আছার' থেকেও তা বুঝা যায়। এটি সহীহ সনদ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। আর তা থেকে কেউ কেউ বসার বিষয়টি ধরে নিয়েছে। কিন্তু কথার দাবি দিয়ে ধরে নেয়ার এ নীতিতে সাধারণত সিফাত সাব্যস্ত করা হয় না। এ জন্য বর্তমান সালাফী আলেমগণের কেউই এ ‘আসার' থেকে বসার বিষয়টি সাব্যস্ত করেন না।
চার. সালাফদের থেকে বেশি কিছু বর্ণনা এসেছে যার মাধ্যমে কেউ কেউ এ অর্থ সাব্যস্ত করেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে শা'বীর বর্ণনায় ইবন 'আব্বাস থেকে (যা সনদের দিক থেকে কর্তিত), আবু ইসহাক আস-সাবি'ঈ, আস-সাওরী, আল-আ‘মাশ, ইসরাইল, আবদুর রহমান ইবন মাহদী, আবু আহমাদ আয-যাবীরী, ওকী', আহমাদ ইবন হাম্বল প্রমুখ থেকে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সনদই বিতর্কিত।
আর উপরোক্ত বর্ণনাগুলো সাব্যস্ত হয়েছে কি হয়নি এ ব্যাপারে মতভেদ নিয়েই এ অর্থটি সাব্যস্ত করা হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে। যারা সেগুলোকে দুর্বল বলেছেন, তারা তা সাব্যস্ত করেননি। আর যারা সেগুলোকে শক্তিশালী বলেছেন তারা তা সাব্যস্ত করেছেন।
সুতরাং তারাও মূলত আল্লাহর সিফাত সাব্যস্তকারী। তাদের সাথে প্রথম অর্থসমূহ সাব্যস্তকারীদের মধ্যে বিশ্বাসগত ও নীতিগত কোনো পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র অর্থটি দলীল প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হওয়া বা না হওয়া নিয়েই তাদের মতপার্থক্য। এ ব্যাপারে মতভেদ দেখিয়ে যেসব জাহমী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে তাদের জানা উচিত, এরা সবাই অর্থাৎ যারা এ অর্থটি সাব্যস্ত করে আর যারা সাব্যস্ত করে না, সবাই একমত যে, যদি এ ব্যাপারে হাদীস শুদ্ধ হয় তবে তারাও সেটা বলবে। তাদের কাছে আল্লাহর 'বসা' তাঁর হাত, পা, আঙ্গুল, চেহারা, চোখ, ‘আরশের উপর উঠা, প্রথম আসমানে অবতরণ, হাসা, আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে তা কোনোভাবেই বেশি নয়। তারা সবাই দলীলের ভিত্তিতেই চলে, আর দলীলের ভিত্তিতেই থামে।
এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, যা শাইখ আবদুর রহমান ইবন নাসের আস-সা'দী বলেছেন,
نثبت أنه استوى على عرشه استواء يليق بجلاله، سواء فسر ذلك بالارتفاع، أو بعلوه على عرشه، أو بالاستقرار، أو الجلوس، فهذه التفاسير واردة عن السلف، فنثبت الله على وجه لا يماثله ولا يشابهه فيها أحد، ولا محذور في ذلك إذا قرنا بهذا الإثبات نفي مماثلة المخلوقات
“আমরা আমাদের রবের ‘আরশের উঠাকে সাব্যস্ত করি, তা যেভাবে তাঁর সম্মান ও মর্যাদার সাথে উপযোগী ও সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাকে যেভাবেই তাফসীর করা হোক না কেন, চাই সেটাকে উপরে উঠা বলা হোক, অথবা তাঁর ‘আরশে উপর উঠা বলা হোক, অথবা ‘আরশের উপরে অবস্থানের কথাই বলা হোক অথবা বসা বলা হোক। এসব তাফসীর সালাফদের থেকে এসেছে। আমরা সেগুলোকে এমনভাবে সাব্যস্ত করবো যা অন্য কারও মতো বা কারও সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া থেকে মুক্ত। আর এতে কোনো নিষিদ্ধ কিছু নেই, যদি এ সাব্যস্তকরণ সৃষ্টির কারও সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া থেকে মুক্ত ঘোষণা করা যায়।”(১৯)
এ হচ্ছে রাব্বুল আলামীনের ‘ইস্তেওয়া’; আরবী ভাষাতে অন্যদের জন্যেও যখন এ শব্দটি على বা إلى যোগে ব্যবহৃত হয় তখনও তা উপরে উঠা অর্থে এসেছে। এমনকি কুরআনুল কারীমেও সেভাবে মানুষের গুণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন,
فَإِذَا اسْتَوَيْتَ أَنتَ وَمَن مَّعَكَ عَلَى الْفُلْكِ فَقُلِ
“অতঃপর যখন আপনি ও আপনার সাথীরা জাহাজের উপর উঠবেন তখন বলুন ...”। [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ২৮]
لِتَسْتَوُداً عَلَى ظُهُورِهِ، ثُمَّ تَذْكُرُواْ نِعْمَةَ رَبِّكُمْ إِذَا اسْتَوَيْتُمْ عَلَيْهِ
“যাতে করে তোমরা তার পিঠের উপর উঠতে পার, তারপর তোমাদের রবের নি'আমতকে স্মরণ করতে পার যখন তোমরা তার উপর উঠবে..।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ১৩]
تُحمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ .... كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْقَهُ، فَتَازَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ، يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظُ بِهِمُ الْكُفَّار
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; আর তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর, তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কচিপাতা, তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক।” [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ১৩]
অনুরূপ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“আর তা জুদী পাহাড়ের উপর উঠলো।” [সূরা হূদ, আয়াত: ৪৪] সুতরাং বুঝা গেল যে, ‘ইস্তেওয়া’ শব্দটি যখন على বা إلى যোগে ব্যবহৃত হয়, তখন উপরে উঠার অর্থই সর্বজন স্বীকৃত।
১. ইবন আবী হাতেম (৬/১৯২৫)।
২. ইবন হাজার, তাগলীকুত তা'লীক (৫/৩৪৫)।
৩. শারহু উসুলে ই'তিকাদে আহলুস সুন্নাহ (৩/৩৯৯); যাহাবী, আল-আরবা‘ঈন ফী সিফাতে রাব্বিল ‘আলামীন, পৃ. ৩৭ ।
৪. (৮/১৩৮); সূরা ত্বা-হা এর আয়াতের তাফসীরে।
৫. আল-বাইহাক্বী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত: ৮৭২।
৬. তাফসীরে বাগাওয়ী (৩/২৩৫)।
৭. মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন, শারহুর আকীদাতিল ওয়াসেত্বিয়্যাহ: (১/৩৩৩)।
৮. ইবনুল কাইয়্যেম, আস-সাওয়া'য়িকুল মুরসালাহ ৪/১২৮৮; যাহাবী, আল-‘উলু (২/১৩০৩)।
৯. আয-যাহাবী, আল-উলু, ১৮০।
১০. আত-তামহীদ (৭/১৩১)।
১১. তাফসীরে বাগাওয়ী (৩/২৩৫)।
১২. আল-‘উলূ ২৩৯।
১৩. আল-ই'তিকাদুল কাদেরী, পৃ. ৩; আল-মুস্তাযাম (১৫/২৮০-২৮২); ইবন কাসীর, আর-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (১২/২৬-৪৯); যাহাবী, তারীখুল ইসলাম (২৮/২৬৮-২৮৬)।
১৪. শারহু হাদীসুন নুযুল, পৃ. ৩৯০।
১৫. দারউ তা'আরাছুল আকলি ওয়ান নাকলি (৬/২৫৩-২৫৪; ইবনুল কাইয়্যেম, আস-সাওয়া'য়িকুল মুরসালাহ (৪/১২৮৮)।
১৬. আন-নূনিয়া।
১৭. নূনিয়াতু ইবনিল কাইয়্যেম, কবিতার ছত্র নং ১৩৫৩-১৩৫৬।
১৮. দেখুন, শারহু কিতাবুত তাওহীদ মিন সহীহিল বুখারী (১/৩৫৬)।
১৯. আল-আজওয়িবাতুস সা‘দিয়্যাহ 'আলাল মাসায়িলিল কওয়াইতিয়্যাহ পৃ. ১৪৬।